রাজকুমার
ঘোষ -
(১)
সাল,
১৯৮৪... তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর সেই
সময় পশ্চিমবঙ্গ তথা হাওড়ার সমস্ত অঞ্চলে এক অস্থির পরিস্থিতি। জায়গায় জায়গায়
অ্যান্টিশোস্যালদের দৌরাত্ম্য। বিভিন্ন দলের মধ্যে দাঙ্গা, মারপিট, লুটপাট চলছে। যার
প্রভাব হাওড়ার দাসনগর-রামরাজাতলা এলাকাতেও পড়েছিল। এছাড়াও এখানকার কিছু প্রভাবশালী
মানুষের লোহার কারখানা, সেখান থেকে নিস্কাশিত লোহার ছাঁট, সেই লোহার ছাঁটের
ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে হামেশাই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি, তোলাবাজি... ঘন ঘন পুলিশের
যাতায়াত, সবকিছু নিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক যুবকেরা এই
দ্বন্ধে সামিল হয়ে খুন হয়েছিল। কত মায়ের
কোল খালি হয়ে গিয়েছিল। রাজের পরিবারের কোন একজন ওই বিশেষ ছাঁটের অংশিদার ছিল, ফলে
পরিবারের ওপর পাড়ার অনেকেরই বিরূপ দৃষ্টি। ওর বয়স তখন বারো।
ওদের একটি পারিবারিক ব্যবসা ছিল। রাস্তার ধারেই ওদের ব্যবসার জায়গাটা... কোনো একটা দিন রাজ ওদের পারিবারিক
ব্যবসার জায়গায় বসেছিল... ঠিক তার বিপরীত দিকের দেওয়ালে একটা
সিনেমার পোস্টার ছিল, ‘লোহা’... শ্রেষ্ঠাংশে,
ধর্মেন্দ্র, শত্রুঘ্ন সিনহা, মাধবী, অমরীশ পুরি ও আরো অনেকে... । ছেলেটি
বেশ জোরে জোরে নামগুলো পড়ছিল । ঠিক সেই সময়
পাড়ার এক তরুন নেতা লোচন সরকার (থুড়ি ন্যাতা বলাই ভালো) ওদের ব্যবসার জায়গায় কোনো এক দরকারে এসেছিল । ছেলেটির
ঐ জোড়ে জোড়ে পড়া শুনে বলল,
“কিরে ফচকে, কিসে পড়িস
?”
“ক্লাস সিক্স”...
“এর বেশি আর হবে না...!
বোঝা গেল সেই পাবলিক রাজকেও লোহার ছাঁটের মত ভাবছে বা ভাবতে
শুরু করেছে...!
কোন একজনের
ওপর ধারণা নিয়ে এই পাবলিকের এহেন মন্তব্য রাজের ছোট্ট মনকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। হতে পারে
রাজ এই পরিবারেরই একজন, কিন্তু নিজস্ব সত্তা ! সেটাও কি ওই লোহা ছাঁটের অংশিদারদের
মতো... রাজ নিজেকে বারে বারে প্রশ্ন করে- “আমি কি একটু আলাদা হতে পারি না, একটুও
কি নিজের জগত গড়ে তুলতে পারি না” । সে তার বাবাকে জানিয়েছিল, কিন্তু
তিনি অত গুরুত্ব দিলেন না, ‘নিজের কাজ করে যাও’... এড়িয়ে গেলেন বুঝতে পারলো । শুরু হল নিজেই
নিজেকে প্রশ্ন করার এক দৃঢ় সংকল্প । নিজের অন্তরের কোন এক অনুভবের
জায়গা থেকে উওরও পেতে থাকলো। সেই পাবলিককেও কোনদিন
সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। নীরবে
থেকে একটু একটু করে নিজেকে খানিকটা আলাদা রাখবার চেষ্টা করে গেছে। ছয়
বৎসর পরে উচ্চমাধ্যমিকে পাড়ার সকল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তারই বেশি নাম্বার আসে, কলেজে
ভর্তি নিয়ে বেশ চাপা টেনশন। তাকে ব্যঙ্গ করেছিল সেই মহান পাবলিক
লোচন সরকার, পরম সোহাগে বলেছিল,
- তোমার কলেজের ভর্তি কেউ আটকাবে না, বেশি চিন্তা করো না ।
রাজ মুচকি
হেসেছিল আর অবাক হয়ে সেদিন ভেবেছিল হয়তো নীরব প্রতিবাদের মাধ্যমে নিঃশব্দে একটি
সুস্থ পরিস্থিতির প্রত্যাবর্তন ঘটাল।
(২)
রাজের
এই প্রত্যাবর্তনের প্রাথমিক ধাপ সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সামনে পড়ে
আছে বিশালাকার পাহাড়প্রমাণ জীবন। অজস্র ধাপ অতিক্রম করে তাকে পৌছতে হবে তার
কাঙ্খিত লক্ষ্যে। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার পথে পড়ে রয়েছে অসংখ্য কন্টকাতীর্ণ বাধা। তবেই
না সফল প্রত্যাবর্তন। শুরু হয়েছিল তার যাত্রা বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের
পলিটেকনিক কলেজে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হয়ে। ওর বাবার ওকে
নিয়ে অনেক আশা, “যাকগে কেউ তো পরিবারের একজন, যাকে একটা দিক দেওয়া গেল। জীবনের
অঙ্ক এবার বুঝি মিলবে”। একবুক সফল হওয়ার আশা নিয়ে রাজ এগিয়ে চলল তার ভবিষ্যতের
দিকে, তিন বছর পর সফল ভাবে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরীর আশায় এদিক ওদিক ঘুরতেও হলোনা।
এক্সাইড কোম্পানীতে সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ারের ট্রেনিং-এ নিয়োগ হয়ে গেলো। এই পর্যন্ত
শুনতে বেশ ভালো লাগছে, কিন্তু সামনে আছে যে কাঁটাতার, যার বাধা অতিক্রম করতে গিয়ে
রাজের নাজেহাল অবস্থা। ওর কপালে চাকরীর প্রথমেই জুটেছিল এক বর্বর টাইপের বস, মি.
তেওয়ারী। যার কাজই হল সঠিক কাজকে সঠিক মর্যাদা না দিয়ে কর্মীদের অযথা হেনস্থা করা।
রাজদের একটি ছয় জনের সার্ভিস গ্রুপ ছিল,এই তেওয়ারীই ছিল এই গ্রুপের বস। সে সবসময়ই
দেখাতে চাইতো, He is the Boss। ওদের গ্রুপের ছয়জনেই বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতো। মাঝে
মাঝেই ওরা বেড়িয়ে পড়তো বিভিন্ন সার্ভিস সেক্টরে। কলকাতা ছাড়াও
রাঁচি, পাটনা, শিলিগুড়ি গুয়াহাটি, কটক, টাটা বিভিন্ন জায়গায়। সেই সেক্টরের কাজগুলো
ওরাই দেখাশোনা করে নিয়ে আসতো ওদের বসের কাছে, কিন্তু তেওয়ারী ঐ কাজগুলো ঠিকঠাক follow-up না করে ওদের ওপর Bossing Attitude দেখাতো। নিজের
অক্ষমতাকে ওদের ওপর চাপিয়ে দিতো। বলতো, ওরা ছয়জন কেউই ঠিক কাজের নয়। প্ল্যান করে
তেওয়ারী তিন জনকে কোম্পানী থেকে বহিস্কার করে দিলো। রাজ বুঝেছিল ওর কপালেও দুর্ভোগ
আছে। একদিন সেই দিনটাও চলে এলো, কোম্পানীর হেড অফিসে রাজ মুখোমুখি মি. তেওয়ারীর,
“কি হিরো... কাজকর্ম ঠিকঠাক না করে এতো স্টাইল দিচ্ছো, যাও মুম্বাইয়ে ... কি দরকার
চাকরী করার ...
“স্যার, কি
বলছেন আপনি? আমি কি ভুল করলাম বলুন”
“চুপ...
একটাও কথা বলবে না... মুখের ওপর কথা আমি সহ্য করিনা”
অফিসের
তেওয়ারীর আশেপাশে অনেকেই ছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকেই মহিলা... সবাই রাজের দিকে এক দৃষ্টিতে
তাকিয়ে আছে... রাজ আর চুপ করে না থেকে
বলল,
“কি মুশকিল,
আপনি কাজ নিয়ে কথা বলুন, পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে বলার অধিকার তো আপনাকে দিইনি,
আমার স্টাইল এক্কেবারে আমার, সেই নিয়ে এতো কথা কিসের”
“এই আমার
মাথা গরম করিও না, দেখেছো তো তোমার কলিগদের চাকরী কেমন খেয়ে নিয়েছি”
“ওটা ছাড়া
আর কি করতে পারেন আগে সেটা বলুন... আমরা বাইরে বেড়িয়ে যে কাজগুলো নিয়ে আসি, সেই
কাজগুলোর feedback কি কখনো দিয়েছেন? সেগুলো না দিয়ে এই সবই করুন, আর শুনুন এই চাকরীর
ভয় দেখাবেন না। আমরা ছয়জন সকলেই Technical certified student, একটা চাকরী ছেড়ে আর একটা চাকরী পাওয়ার ক্ষমতা রাখি, তো
অত ভয় দেখাবেন না। আপনার দৌড় তো এই অফিসেই, নিশ্চয়ই ছুটির পর এখানেই থাকবেন না, বাড়ি যাবেন তো,
আসুন রাস্তায় অপেক্ষা করছি… আপনার কতটা দৌড় দেখার
অপেক্ষায় রইলুম”
“এই…এই… কি করবে তুমি?”
মুচকি হেসে রাজ,
“চমকে গেলেন দেখছি,
নিচে অপেক্ষায় রইলাম… আর এই চাকরীকে আজই টাটা বাই
বাই”
না রাজ আর
অফিসের নিচে অপেক্ষা করেনি। এতো সস্তা রুচিবোধ ওর মধ্যে কোনোদিনই প্রকট হয়নি,
সেদিনে তো নয়ই। ও নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল এবং কাছেই নন্দনে গিয়ে ওর
পরিচিত কিছু বন্ধুর সাথে আড্ডায় মেতে গিয়েছিল। অবশ্য পরে রাজ কোনো একজনের কাছে
শুনেছিল মি. তিওয়ারী সেদিন অফিস থেকে রাত ৯.৩০ টায় বেরিয়েছিল। এটা শুনে রাজ আরো
হেসেছিল এবং ভেবেছিল- যাকগে মি. তিওয়ারীর মতো একজন অহংকারী লোকও ওর চোখে চোখ রেখে
কথা বলার স্পর্ধাকে সেদিন ভয় পেয়েছিল। রাজের কাছে এটা সফল প্রত্যাবর্তন ছাড়া আর
কি! চাকরী আবার পাবে সে, কিন্তু নিজের সম্মান সে তো অক্ষত রেখেছে।
(৩)
রাজের এই চাকরী ছেড়ে দেওয়াতে ওর বাবা খুবই
রেগেছিলেন, তিনি বলেছিলেন সবকিছু মানিয়ে না নিলে জীবন কিন্তু থেমে থাকবে, আর এগোবে
না। রাজ এই কথায় কর্ণপাত করেনি। ও স্থির করেছিল আর চাকরী নয়। তাও দু একটা সরকারী
চাকরীর জন্য দরখাস্ত করেওছিল কিন্তু পরীক্ষা পর্যন্ত সে যায়নি। চাকরী নিয়ে
বিতৃষ্ণা এসেছিল তার। সে ঠিক করেছিলো ব্যবসা করবে, কিন্তু তার এই স্বাধীন ভাবে বাঁচার মূল বাধা ওর বাবা, তিনি চেয়েছিলেন তার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা ছেলে একটা ভালো চাকরি
করুক। কিন্তু তার মাথা গরম ছেলের এক্সাইড কোম্পানীর চাকরি ছেড়ে দেওয়াতে
তিনি বেজায় রুষ্ট। তিনি কখনো চাননি রাজ ব্যবসা করুক, কিন্তু রাজও নাছোড়বান্দা। সে তার মত করে একটা
দোকান ঘর ভাড়া নিয়ে দু’টি কম্পিউটার নিয়ে কম্পিউটার সেন্টার চালু করে দিলো। এই ব্যাপারে সে তার
বাবার কাছ থেকে কোন রকম সমর্থন ও সম্মতি পেলো না। কোন কিছু না ভেবেই সে
তার দুই বছরের চাকরি করে জমিয়ে রাখা যাবতীয় টাকা-পয়সা দিয়েই সেন্টার চালু করে দিয়েছিলো। ওর পাড়ার সবাই দেখে
ভাবলো এ আবার কিসের দোকান? কম্পিউটার গুলো দেখে
ভাবলো এ নিশ্চয়ই ভিডিও গেমসের পার্লার, আবার কেউ ভাবলো নিষিদ্ধ
সিনেমার সিডি মেকিং-এর দোকান । ওঃ......... বিচিত্র
সব মানুষের বিচিত্র রকম ভাবনা! একদিন, সেদিনের
সেই তরুন নেতা লোচন সরকার(যে এতোদিনে সত্যিই পাড়ার নেতাদাদা হয়ে গেছে) রাজকে ওর ছাত্র-ছাত্রীদের সামনেই বলে ফেললো, ‘কিরে রাত্রিতে
তো খুব উল্টোপাল্টা জিনিস দেখিস’ …… রাজ এমনিতেই মাথা গরম,
কিন্তু এক্ষেত্রে সংযত হয়ে সে তাকে বললো, ‘তোমার
যেমন রুচি, এই প্রশ্ন করাটাই স্বাভাবিক, এর থেকে বেশি তোমার থেকে আর কি আশা করা যেতে পারে !’… রাজের এই কথা শুনে সে সেখান থেকে
চলে গেলো।
রাজ মনপ্রাণ আর নিষ্ঠা দিয়ে
কম্পিউটার সেন্টারটি চালু করেছিল, ওর সমস্ত পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে সাজিয়ে তুলেছিল।
আস্তে আস্তে তার ফল হিসাবে কিছু ছাত্র-ছাত্রী
কম্পিউটার শেখার জন্য ভর্তি হয়েছিলো, এছাড়াও নেট-সারফিং ও টাইপিং-প্রিন্টিং এর কাজও হতো । প্রায় দুই মাস পরে ওর স্বপ্নের
কম্পিউটার সেন্টারটি সুন্দর ভাবে চালু হয়ে গেলো, যথেষ্ট ছাত্র-ছাত্রী ওর কম্পিউটার
সেন্টারে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। ওর ব্যস্ততাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো। একাই নিজের
হাতেই সবকিছু দেখাশোনা করতো। ওর আত্মবিশ্বাসও বাড়তে থাকলো, ওর মনে হয়েছিল নিজের
পরিশ্রম কোন সংস্থায় না দিয়ে নিজের তৈরী করা জায়গায় দেওয়া অনেক ভালো, তাতে আয় যাই হোক না কেন নিজের মর্জির মালিক হওয়া যায়। ওর সাজানো বাগান ফুলে
ফুলে আরও সাজিয়ে উঠলো। রাজের বাবাও ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে ভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন, খানিকটা হলেও তা কাটলো, ভাবলেন ছেলের নতুন
ব্যবসা মোটামুটি ভাবে এগোচ্ছে। ওর বাবার এই ভাবনাতেই কার যেন বিষ নজর লেগে গেলো। ঠিক ছয় মাস পর একটা
অপ্রত্যাশিত ঘটনা রাজকে কোনঠাসা করে দিলো।
(৪)
সেদিন ছিলো বুধবার, কালিপূজোর ঠিক ক’দিন আগে, প্রতিদিনের মতোই রাজ তার ছাত্রদের নিয়ে ক্লাস করছিলো। ওর কাছে একটা ছেলে কিছু
বাংলা টাইপ করে প্রিন্ট করবার জন্য এসেছিলো। ছাত্রদের ক্লাস করার জন্য রাজ ওই
কাজটি করতে অস্বীকার করে, কিন্তু ছেলেটি অত্যন্ত
জরুরী বলে অনেক অনুরোধ করে ওকে রাজি করায় । সে কাজটি করে ফেলেছিলো, কিন্তু প্রিন্ট করতে যাবার সময় যত বিপত্তি । ওদেরই দেওয়া একটা পুরানো
লেটার প্যাডে প্রিন্ট করতে গিয়ে কাগজটি প্রিন্টারে বিশ্রী ভাবে আটকে যায়। নতুন প্রিন্টারের শোচনীয়
অবস্থা দেখে রাজের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম, সে
ওই ছেলেটিকে জানালো তার দেওয়া এই পচা লেটার প্যাডটির জন্য এই পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে। ওই ছেলেটির আর এক সাথী
বাইরে অপেক্ষা করছিলো, সে তখন সেখানে এসে বললো,
“তোর প্রিন্টারের থেকে কাগজটির গুরুত্ত্ব অনেক বেশি রে” – এরপর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগলো। সেই সময় সেন্টারে কিছু
ছোট ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও রাজের মা টিফিন নিয়ে
দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাজ ভীষন অপমানিত বোধ করলো, ও মাথা গরম করে ফেললো। ও রেগে গিয়ে ওই দ্বিতীয় ছেলেটিকে একটা থাপ্পড় দিয়ে
সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে বললো। ছেলেগুলো রাজকে আরও গালিগালাজ করে শাসাতে লাগলো
এবং জানালো, সে ওদের গায়ে হাত দিয়ে ঠিক করেনি। রাজ আরো রেগে গিয়ে ওদের
সাথে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লো। রাজের ভাই সেখানে এসে মিটমাট করতে গিয়েছিলো, কিন্তু ওর দাদার ওপর ওদের আক্রমণ দেখে সেও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লো। রাজ ওদের দুজনকে রাস্তার
ওপর টেনে নিয়ে গিয়ে বেশ করে উত্তম মধ্যম দিলো। ওরা সেখান থেকে পালিয়ে
যাবার আগে বলে গেলো দল নিয়ে ওরা আবার আসবে, ওদের
অনেক বড় অসামাজিক দাদা আছে। রাজকে ওর দিন আপাততঃ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকতে বলে
ওরা ওখান থেকে চলে গেলো।
রাজের কম্পিউটার সেন্টারে অপ্রত্যাশিত এই মারপিটের সৌজন্যে চারপাশে অনেক কৌতূহলী
জনতার ভীড় হয়ে গেলো। তারা সবাই রূপোলী পর্দার দৃশ্য মনে করে অবাক হয়ে দেখছিলো। তাদের মধ্যেই বেশ কিছুজন
তৃপ্ত মনে রাজকে জানালো, ওই ছেলেগুলো সমাজ বিরোধী, ওদের কাজই হলো ঝামেলা পাকিয়ে মানুষকে বিব্রত করা, মানুষকে
মারধোর করা, টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়া। এমন কি মানুষ খুন করাও
ওদের কাছে জলভাত। তাদের বক্তব্য শুনে ওর মনে হলো এই পরম শুভাকাঙ্ক্ষীরা এতক্ষণ
তাহলে মজাই দেখছিলো, ঠিক আছে, আরও না হয় মজাই দেখুক, এই ভেবে ও ওদের জন্য অপেক্ষা করতে
লাগলো। ও ঠিক করে নিয়েছিলো, যতজন
সমাজ বিরোধী গুন্ডা আসুক না কেন, যা মস্তানি করার ওকে একাই করতে
হবে। ও মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নিলো। কাউকে ওর পাশে চাই না, নিজের সমস্যা নিজেই মেটাবে। ও ওর ভাইকে ওখান থেকে
চলে যেতে বললো। রাজের মাও দুশ্চিন্তা নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পরেই ছয় জনের
একটা দল বাইক নিয়ে এলো। রাজকে একা পেয়ে সবাই মিলে মারধোর করলো, তাতে রাজের মাথা, নাক, মুখে প্রচন্ড আঘাত লাগলো, ওর পেট ও বুকে অসহ্য যন্ত্রণা
অনুভূত হলো। ওর ঠোঁট দিয়ে রক্ত বেরোতে লাগলো। তা সত্ত্বেও রাজ ওদের
সাথে মস্তানি দেখাতে গেলো কিন্তু পেরে উঠলো না। ওর ভাই ওদের হাত পা
ধরে দাদার প্রাণভিক্ষা করতে লাগলো। রাজের মা এই দৃশ্য দেখতে না পেরে হাউ হাউ করে কাঁদতে
লাগলো। তিনিও ওই গুন্ডাগুলির হাত-পা ধরে ছেলেকে আঘাত না করার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু ওরা মানুষরূপী
কুকুরের দল, মায়ের কান্না ওরা কেন বুঝবে? রাজের
মায়ের করূণ আর্তি ওখানে ভীড় করে থাকা জনতাদের কাছে, “ওগো তোমরা বাঁচাও আমার ছেলেকে…
ওরা যে আমার ছেলেকে মেরে ফেলবে” … কিন্তু সবাই
যে রূপোলী পর্দার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। অবশেষে গুন্ডাগুলো রাজকে
প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ আহত করে জানিয়ে গেলো, “ফার্স্ট
রাউন্ডের খেলা শেষ হলো… সেকেন্ড রাউন্ডের জন্য অপেক্ষা কর,
চিন্তা নেই, থার্ড রাউন্ড আর হবে না” …
রাজ প্রচন্ড আঘাত নিয়েও ওদেরকে চ্যালেঞ্জ জানালো। রাজ
ঠিক করে নিয়েছিলো পরের বার যতজনই আসুক না কেনো, ওর মস্তানি শেষ
পর্যন্ত দেখিয়েই যাবে। ওর স্থির বিশ্বাস ছিলো ও মরে যাবার আগে অন্ততঃ একজনকে
মেরেই মরবে, কাপুরুষের মত বেঁচে থাকার চেয়ে এই
স্বার্থপর দুনিয়া থেকে লড়াই করে চলে যাওয়া ঢের ভালো, কিন্তু নিজের
মাকে দেখে রাজের খুব কষ্ট হচ্ছিল। এরপর ওখানে থাকা ওর ভাইয়ের কিছু
বন্ধু রাজকে প্রায় জোর করেই বাড়িতে নিয়ে চলে আসে, ওর কম্পিউটার সেন্টার টিকেও বন্ধ করে দিলো, যাতে ওরা
এসে ভাঙচুর করতে না পারে। বাড়িতে নিয়ে এসে ওরা রাজকে শুশ্রুষা করে, এরই মধ্যে ওর বাবাও চলে আসে । উনি সমস্ত কিছু শুনলেন
তারপর বললেন, “তোর দ্বারা কিছুই হবে না,
এই মাথা গরমের জন্য চাকরিও হল না, এখন সাজানো সেন্টারটাও
নষ্ট হয়ে যাবে” । … রাজ
নির্বাক হয়ে ওর বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো।
(৫)
রাজ বাড়িতে চলে আসার পর ঐ জানোয়ারগুলো তাদের আরো দশ জন সাথীকে নিয়ে রাজকে শেষ করার
উদ্দেশ্যে ওর কম্পিউটার সেন্টারে চড়াও হয়েছিলো। ওরা এসে রাজের বাড়ির
খোঁজ করছিল, কিন্তু না পেয়ে ওরা আশেপাশের সবাইকে
শাসিয়ে চলে গিয়েছিলো এবং বলে গিয়েছিলো ওরা আবার এসে ওদের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করেই নিস্তার
নেবে। সেদিন থেকে রাজ প্রায় তিন দিন ওর কম্পিউটার সেন্টার খুলতেই পারেনি। রাজের খোঁজে ওই গুন্ডাগুলো
প্রতিদিনই আসতো। এদিকে রাজ কার্যতঃ গৃহবন্দি, ওর বাবা কিছুতেই ওকে বাড়ির বাইরে বেরোতে দেয়নি। একটা চালু কম্পিউটার
সেন্টার কদিন ধরে বন্ধ থাকায় রাজ খুব আশাহত হয়ে পড়লো। রাজের বাবা ও মা পুলিশের
কাছে যেতে চায়নি, কারন ‘রক্ষক ই ভক্ষক’ এই প্রবাদ বাক্যটি ওনাদের মাথার মধ্যেও
ছিলো। ওনারা ঝামেলাটিকে অন্য কোন উপায়ে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য ক্রমাগত
চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, সেই ব্যাপারে তারা অনেক
বিজ্ঞজনদের কাছে গেলেন। তারা কেউ আশা দেখালো, কেউ ভয় দেখালো, কেউ জ্ঞান দিলো, কেউ আবার ব্যঙ্গও করলো। তাদের মধ্যে আবার সেই নেতা দাদা লোচন সরকারও ছিলো, সে তো বলেই ফেললো, “আমি থাকলে সব কটাকে মেরে
ভাগিয়ে দিতাম”… ওই পর্যন্ত্যই তার দৌড়। মধ্যস্থতা করার কথা বলতেই “দেখছি” বলে এড়িয়ে গিয়েছিলো।
রাজ নিজেকে ভীষন অসহায় মনে করতে
লাগলো। নিজের পাড়া, নিজের
বাড়িতেই ওর নিজেকে উদ্বাস্তু মনে হলো। তারপর শুভানুধ্যায়ীদের
ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তার মধ্যে নিয়মিত বাবার ধমক তো ছিলোই। ওর সেন্টারের এই হামলার
খবর অন্যান্য পাড়াতেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। সেই সব জায়গায় রটে গেলো যে মেয়েঘটিত কারণে এই ভয়ানক
ঝামেলা, এই ফালতু রটনায় রাজের মানসিক অবস্থা একেবারে
তলানিতে চলে গিয়েছিলো। ওর আত্মবিশ্বাসে সামান্য হলেও চিড় ধরেছিলো। এক মুহুর্তে রাজের মনে
হয়েছিলো যে কি হবে এই ভাবে বেঁচে থেকে, তার
থেকে নিঃশব্দে চলে যাওয়াই ভালো হবে। তাতে বাবা-মা ও ভাই প্রতিকূল অবস্থা থেকে রেহাই পেয়ে যাবে, পরক্ষনেই ও তাদের কথা ভেবে এই বাজে চিন্তা থেকে সরে এসেছিলো। দেখতে দেখতে কালীপূজো
চলে এলো, কিন্তু দিপাবলীর আলোর রোশনাইতেও রাজের জীবনে
ঘোর অন্ধকার। এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ খুঁজে না পেয়ে ও দিশাহারা
হয়ে পরলো।
অবশেষে চার দিনের মাথায় রাজের
মা ওকে নিয়ে ওনার এক পিসতুতো ভাইয়ের সাহায্যে অন্য পাড়ার এক প্রভাবশালী নেতার কাছে
গেলেন। সাথে রাজের বাবাও ছিলেন। সেই ব্যক্তিকে সব কিছু
বলা হল। উনি বিশষতঃ রাজের কাছ থেকেই সব কিছু জানতে চাইলেন। রাজ সবকিছু বৃত্তান্ত
ওনাকে জানালো, উনিও মন দিয়ে সবই শুনলেন। রাজের বাবা, মা, ঐ প্রভাবশালী নেতা ও ওখানে উপস্থিত বাকি
সবাই অবাক হয়ে গেলেন রাজের শেষ কথা শুনে, ‘আমার তো মনে হয়না আমি
কোন অন্যায় করেছি, আমি শুধু প্রতিবাদ করেছি । ভবিষ্যতেও সুযোগ পেলে
এই রকম প্রতিবাদ বারবার করবো”... ওর মুখে এই কথাটি
শুনে ওর বাবা ভীষন রেগে গেলেন । রাজ ওনার সামনে থাকলে হয়তো মেরেই দিতেন, উনি রাজকে বেশ করে ধমক দিলেন। কিন্তু ঐ প্রভাবশালী
নেতা ভদ্রলোক রাজের বাবাকে থামিয়ে দিলেন। উনি রাজের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ
তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “যা করেছিস, বেশ করেছিস… বাঘের বাচ্চার মত কাজ করেছিস। তুই মাথা উঁচু করে থাক… ওরা কি ভেবেছে, মস্তানি কি শুধু ওরাই করবে”
… এরপর উনি আশ্বস্ত করে আরো বললেন, “শোন,
আজ থেকেই যেন তোর কম্পিউটার সেন্টার খুলে যায়, তা না হলে আমি তোকে পেটাবো”… রাজের প্রাণে যেন বল ফিরে
এলো, ও ভাবলো কেউ তো আছেন যিনি ওর মস্তানিকে সমর্থন করেছেন। ভদ্রলোক কথা দিলেন প্রয়োজন
মত উনি রাজের সাথে কম্পিউটার সেন্টারে থাকবেন। উনি কিন্তু ওনার কথা
রেখেছিলেন, পরপর তিনদিন উনি রাজের সাথে
কমম্পিউটার সেন্টারে ছিলেন। অবশ্য ওনার কিছু টাইপিংএর কাজও ছিলো। ঐ তিনদিন রাত ১১টা পর্যন্ত্য
রাজের কম্পিউটার সেন্টার খোলা হয়েছিলো। এরপরও রাজের বাবা সেই সমাজ বিরোধীদের কালিপূজোয় দুটো
কম্বলের দাম দিয়েছিলো যা কিনা গরিব মানুষদের দান করা হবে। হায় রে বিধাতা! প্রতিবাদ করলেও দান করতে হবে !... না চাইলেও
রাজকে ব্যাপারটা মেনে নিতে হয়েছিলো। হতভাগা গুন্ডাগুলো ওই তিনদিন দিন
তো বটেই, তারপরেও এই অঞ্চলে আর আসেনি। সেদিন থেকে রাজ ওর
কম্পিউটার সেন্টারে ভীষণ সতর্ক হয়ে কাজকর্ম করতো, কিন্তু মস্তানদের ও যেভাবে মস্তানি দেখিয়ে এক সফল প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছিল তা
শুধু স্মৃতিতে ঠাসা হয়েই রয়ে গেলো।
(৬)
রাজের মনে হয়েছিলো ও ভাগ্যবান বলে এইরকম এক ব্যক্তির
সান্নিধ্য পেয়েছিলো, কিন্তু ওই গুন্ডাগুলো এরপর অন্য কোন রাজকে,
যে হয়তো প্রতিবাদের ভাষা জানে না… তার কি হবে?...ওর মস্তানির নিস্পত্তি শুধুমাত্র দুটো কম্বল দান করে…এই ভেবে ওর মনে কখনো সন্তুষ্টি আসেনি। আজ পনেরো বছর পরেও রাজ সেই অসন্তুষ্টি বয়ে বেড়াচ্ছে। সেই দূর্ভাগ্যজনক ঘটনাটিকে ছাপার অক্ষরে সাজিয়ে দিয়ে সে
আজ নিস্তার চায়, সে মস্তানির স্মৃতিগুলোকে আর ধরে রাখতে চায় না। এখন রাজের কম্পিউটার সেন্টারে সবাই আসে, যারা দোকান বলে ব্যঙ্গ করতো তারাও কম্পিউটার
সেন্টার মনে করেই আসে, এছাড়া অনেক গণমান্যরাও আসে যারা রাজকে
নিজের পাড়ার লোক বলে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে… রাজও নিজের প্রাপ্য জিনিস বুঝে নিয়ে তাদের সেই সুযোগ সুবিধা দেবার চেষ্টা করে। পাড়ার সেই নেতা লোচন সরকারও মাঝে মাঝে তার কাজকর্ম করার
জন্য আসে। কিন্তু তার প্রতি রাজের একটা বিরূপ মনোভাব তৈরী
হয়েছে, ফলে সে কাজ করতে ওর ভালোই লাগে না, ও বলে, “আমার দ্বারা এ কাজ হবে না”... প্রত্যুত্তরে
সেই মাতব্বর জানায়, “তোর দ্বারা হবে নাতো, কার দ্বারা হবে বাবা
?” ওর তখন ভীষণ হাসি পায় এছাড়াও ঐ নেতা ক্লাবের পূজোতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার
জন্য রাজকে অনুরোধ করে। রাজ দিতে অস্বীকার করায় সে
বলে, “বিপদ-আপদে ক্লাব ও পাড়ার লোকেরাই তো পাশে থাকবে”… রাজ ওর চোখে চোখ রেখে শুধু মুচকি
হাসে। এই মুচকি হাসির মধ্যে নীরব প্রতিবাদের অর্থ লোচন
সরকার বুঝলো কিনা রাজ জানেনা কিন্তু আজও পাড়ার সবচেয়ে পুরানো বাসিন্দাদের অন্যতম হয়েও
রাজ প্রতিদিনই নিজেকে নিয়ে ওদের পাড়ায় সুস্থ প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করে যায়।
প্রকাশিত - পদক্ষেপ পত্রিকা, চুঁচুড়া, উৎসব সংখ্যা, ২০১৭
জীবনে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পিছনে বাধা অতিক্রম করেও রাজের প্রত্যাবর্তন.. .সত্যিই অভাবনীয়...এটা নিছক গল্পই নয়..একজনের জিবনের ঘটনাও বটে...।।
ReplyDeleteএকদম ঠিক... আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই...
Deletemy favourite
ReplyDelete