Monday, August 13, 2018

ছোট গল্প - ফাগুন



রাজকুমার ঘোষ -
রাজ দিল্লীর একটি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ফাইনাল ইয়ার স্টুডেন্ট ছিল । পরীক্ষার একমাস আগে দোলের সময় ও বাড়িতে এসেছিল । দোলেতে ওদের বাড়িতে বেশ বড় করে রাধাকৃষ্ণের পূজো হত, অনেক লোকের সমাগম হত । সারা বাড়িতে খুশির দোলে সেইদিনটা দারুন আনন্দে কাটছিল, ওর একমাত্র ভালোবাসা রিমিও এসেছিল ওদের বাড়িতে । রঙে রাঙা মন নিয়ে ওদের দুজনের চোখে চোখে কত কথা হচ্ছিল কিন্তু কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল ...... রঙের খেলায় মাতিয়ে ওঠা সেই দিনটা হঠাৎ করে কিভাবে বেরঙ হয়ে গিয়েছিল তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। সেদিন ওর বাড়ির পাশেই মেন রাস্তার ওপর ওদের পাড়ার বিশু একটি মেয়েকে প্রায় বিবস্ত্র করে রঙ মাখাতে গিয়েছিল, মেয়েটির চিৎকারে ওদের বাড়ির ও আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বেরিয়ে এসেছিল কিন্তু কেউ মেয়েটাকে বাঁচাবার সাহস করেনি, রাজও বেরিয়ে এসেছিল, ও বিশুকে সেখান থেকে চলে যেতে বলে কিন্তু আকন্ঠ মদ্যপান করে বিশু ওকে গালিগালাজ করে মেয়েটির ওপর আরো ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল । তারপর রাজের সাথে বিশুর হাতাহাতি হয় এবং বিশুকে মারধোর করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল । তার খানিক বাদে বিশু তার দলবল নিয়ে এসে রাজের ওপর চড়াও হয় । রাজ আবার ওদের সাথে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পরে এবং এক বিশৃঙ্খল পরিবেশের সৃষ্টি হয়ে যায় । রাজ একাই ওদের সাথে লড়াই করে কিন্তু পুলিশের গাড়ি আসাতেই ওরা পালিয়ে যায় এবং বিশু রাজকে শাসিয়ে যায়, “আমার হাত থেকে তোর নিস্তার নেই”
এদিকে ওর বাবা, দাদা ওকে তীব্র ভৎর্সনা করে । দোল উৎসবে ওদের বাড়িতে উপস্থিত সকল লোকের মাঝে বাবা ও দাদা রাজকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে বলে এবং ও বেড়িয়েও যায় । রাজ বাড়ি থেকে চলে যায় ওর এক প্রিয় মানুষের বাড়ি, যিনি হলেন ওর মাস্টারমশাই কল্যানবাবু। ওর মনের মানুষ রিমি এই কল্যান বাবুর মেয়ে । রিমিও সাথে সাথে চলে আসে । তারপর রাজ রিমির বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে সেখান থেকে হাওড়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়। সেদিন রাতেই ও পূর্বা এক্সপ্রেসের জেনারেল কামড়ায় উঠে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল । সেদিন থেকে রাজ ওর বাড়ির সাথে আর যোগাযোগ রাখেনি । অবশ্য সে রিমির কাছ থেকে বাড়ির সব খোঁজ-খবরই নিত। দিল্লী পৌছেই রিমির কাছে থেকে জানতে পেরেছিল, সেদিন বিশুর দল অন্য আরেকটি পাড়ায় গিয়ে মারপিট-এ জড়িয়ে পরে এবং ঘটনাস্থলেই নাকি বিশু মার্ডার হয়ে যায় । সে ক্ষেত্রে রাজ-এর বাড়িতে সেইভাবে আর কেউ এসে বিরক্ত করেনি । সবাই এটাকে একটা পাপ মিটে যাওয়ার মত ভেবে ভুলে গিয়েছিল । কিন্তু রাজ, সে আর বাড়িতে কারোর সাথে যোগাযোগ রাখেনি কিন্তু ওর মায়ের জন্য ওর মন খুব খারাপ হয়ে যেত । বেরিয়ে যাওয়ার দিনে ওর মায়ের কান্না ওকে ভীষণভাবে কষ্ট দিয়েছিল, সেকথা ভাবলে ওর মন বারেবারে বাড়িতে ফিরে আসতে চায় । রাজ সংকল্প করেছিল যতদিন না ও প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততদিন ওর এই মুখ বাড়ির কাউকে দেখাবে না ।
প্রায় চার বছর পর বাড়ি ফেরার পথে ওর সেইদিনের কথা ভেবে মনটা বেশ ভারী হয়ে উঠল । শুধু রিমিই তার একমাত্র ঠিকানা । এখন রাজ এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করছে । পরীক্ষায় বেশ ভালো ভাবে পাশ করার পরই ও চাকরি পেয়ে যায় । কোম্পানী ওকে ফ্ল্যাট, গাড়ি সবই দিয়েছে । এই ক’বছরে রিমি ওর পাশে থেকে ভীষণ সাহস জুগিয়েছে । রাজ ঠিক করেছে এবার বাড়ি গিয়ে রিমিকে একেবারের জন্য ওর কাছে নিয়ে চলে আসবে । মাস্টার মশাই কল্যান বাবুকেও সবই জানিয়েছে । তিনি খুবই খুশি হয়ে সম্মত জানিয়েছেন, সেই ছোট থেকে রাজকে তিনি মানুষ করেছেন বলা যেতে পারে । রাজ রিমিকে বারণ করেছে, ওর আসার কথা যেন ওর বাড়ির লোক জানতে না পারে । এই ক’বছরে বাড়ির লোকও যে খোঁজ করেনি তা নয়, কিন্তু রাজই যোগাযোগ রাখেনি । ও শুধু ওর মায়ের কথা ভেবে মন খারাপ করেছে । অবশেষে রাজ দোলের দিনেই ফিরলো, ঐ দিন সকালে রিমি ও কল্যানবাবু হাওড়া থেকে ওকে আনতে গিয়েছিল । সেখান থেকে রাজ প্রথমে রিমির বাড়িতেই যায় । বেলার সময় কল্যানবাবু রাজ ও রিমিকে নিয়ে ওদের বাড়ি নিয়ে যায় । রাজের বাড়িতে দোলের দিনে রাধাকৃষ্ণের পূজো হয় সেই উৎসবে অনেকেই এসেছে, তাই কল্যানবাবুকে আসতে দেখে ওদের বাড়ির সবাই কল্যানবাবুকে স্বাগত জানাতে আসে । রাজের মুখ রঙ দিয়ে রাঙানো ছিল তাই সেইভাবে কেউ বুঝতে পারেনি । কিন্তু ওর মা ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়েছিল । রিমির পাশেই ও দাঁড়িয়েছিল, কল্যানবাবু পরিচয় দিল, “দেখুন, আমার জামাই কে... চিনতে পারেন কিনা দেখি...”... সবাই ঠিকমত বুঝে উঠতে না পারলেও ওর মা এবার অঝোরে কাঁদতে লাগল । রাজেরও চোখ দিয়ে অজস্র অশ্রুবিন্দু যেন ওর ভারী হয়ে যাওয়া বুকটাকে এক নিমেষে অনেকটা বোঝামুক্ত করে দিল । বাকিদের আর বুঝতে অসুবিধা হল না । মা কাঁদতে কাঁদতে রাজকে বুকে জড়িয়ে ধরল । অনেকদিন পর ওর বাবা-দাদা ও বাড়ির বাকিরা রাজকে দেখতে পেয়ে ওকে আর পুরনো কথা কিছু জিজ্ঞেস করল না কারণ রাজের এই হঠাৎ আগমণে সব কিছু রঙীন হয়ে গেছে । দূরে কোথাও মাইকের আওয়াজে ভেসে এল, “ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে......” ... সবাই রাজ ও রিমি-র বিয়ে নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেল...... তারপর রাধাকৃষ্ণের পূজোর সময় রাজ ও রিমি একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে অনেক কথা বলতে লাগল ......... ।
 
প্রকাশিত - "স্বপ্ন উড়ান" পত্রিকার নববর্ষ সংখ্যা, ২০১৬  

No comments:

Post a Comment