Friday, November 2, 2018

বড়গল্প - নিশা



রাজকুমার ঘোষ -
(১)
ছোট্ট নিশাকে রসুল, কাদের, জামালরা কিডন্যাপ করে । গুলমার্গের বরফে আবৃত প্রাকৃতিক শোভায় বিভোর হয়ে নিশার পাপ্পা-মাম্মি আত্মহারা । বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তুলোর মতো ছড়িয়ে থাকা বরফের কণা, তার ওপর রোদ্দুরের মিষ্টি রশ্মি, ছোট বড় চিনার গাছে বরফের চাদর সব মিলিয়ে ওরা মোহিত হয়েছিল ।
- বাপুজি আপকা বেটি কাহা হে – গাইডের জিজ্ঞাসাতে ওদের হুঁশ আসে । এইতো নিশা ছিল ওর পাপ্পার হাত ধরে, কোথায় গেল ? খেয়ালই নেই যে তাদের একমাত্র ফুটফুটে মেয়েটাকে রসুলরা মুহুর্তের বিভোরতায় তুলে নিয়ে গেছে । সমস্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মোহ তৎক্ষনাৎ তলানিতে চলে গিয়ে ওরা যত্র-তত্র ছোটাছুটি, খোঁজাখুঁজি করতে লাগল ।
(২)
এদিকে নিশাকে নিয়ে রসুলদের উদ্দেশ্য বেশ ভয়ঙ্কর, ওকে নিয়ে বর্ডারের কাছে গেলেই বেশ চড়া দাম পাবে। তবে কাঁটাতারে আটকে থাকা মেন রাস্তার মূল গেট দিয়ে অবশ্যই নয়, কারণ ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে হয় ভারতীয় সেনা না হয় পাশের দেশের সেনাদের হাতে পড়ার বিপুল সম্ভাবনা। তাই মাটির তলা দিয়ে দুই দেশের বর্ডারের মাঝে একটা চোরা গুপ্ত রাস্তা আছে সেখান দিয়ে গেলেই ও পারে আছে আব্দুল যে নিশাদের মত কত মেয়েকে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছে তার ঠিক নেই। তবে এই আব্দুলের মত দালালের কাছে রসুলরা সরাসরি যাবে না। ওদের এই পাচার চক্রের ঘাঁটি হল অনন্তনাগে। আপাতত ওরা সেখানেই আসে। এই অনন্তনাগের ঘাঁটি থেকে ওরা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। শুধুমাত্র নারী পাচারই নয়, বোমা তৈরী করা এবং নিজেদের জেহাদির জন্য বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা ছড়ানো সবই হয়। কিছুদিন আগেই ওদের জঙ্গি সংগঠন শ্রীনগরের মূল কেন্দ্রে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়, যার জেরে একজন মন্ত্রীসহ অনেক পুলিশ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। মিলিটারিরা সবই খোঁজ খবর পেয়ে অনন্তনাগের এই ঘাঁটিতে আক্রমণ করতে আসে। মিলিটারির জওয়ানেরা ঐ ঘাঁটিটিকে ঘিরে ফেলে। রসুল, জামাল ও কাদের নিশাকে নিয়ে একটি সাফারি গাড়ি করে সেখান থেকে পালাবার চেষ্টা করে। জওয়ানরা ওদের পিছু নেয়। কিন্তু সাফারি নিয়ে ওরা বেশিদুর এগোতে পারেনি। চলন্ত গাড়ি থেকে রসুল নিশাকে নিয়ে নামবার চেষ্টা করে কিন্তু একটি লোহার রডে রসুলের পেট এফোঁড় হয়ে যায় আর নিশা কপালে চোট পেয়ে চৈতন্য হারিয়ে পড়ে থাকে মৃত রসুলের পাশে। সাফারি গাড়িটা জওয়ানদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য সোজা খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয়। জওয়ানরা একপ্রকার নিশাকে না দেখেই সেখান থেকে চলে যায়। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার মুখে এক কাশ্মিরী দম্পতি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল, তারা নিশাকে দেখতে পায়। মৃত রসুলের পাশে অচৈতন্য অবস্থায় ওকে দেখে ওরা বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নিশাকে ছুঁয়ে বুঝতে পারে নিশার প্রাণ আছে এবং কপাল ফেটে রক্ত বেরোনোয় ওরা তড়িঘড়ি নিশাকে নিয়ে চলে আসে ওখানে অবস্থিত একটি ক্লিনিকে... খানিকবাদেই নিশার জ্ঞান ফিরে আসে ।
“তু কোন হে বেটি, কাঁহাসে আয়া” – নিশা কিছুই বুঝতে পারে না । ওর এই তিন বৎসর বয়সে এই প্রথম পাপ্পা-মাম্মি ছাড়া... তাদেরকে দেখতে না পেয়ে ও ‘পাপ্পাআআআআআ ...... মাম্মিইইইইইইই’ বলে কাঁদতে থাকে। নিশা ঐ কাশ্মিরী দম্পতি ও ক্লিনিকের ডাক্তারকে দেখে আরো ভয় পেয়ে যায়। আর কিছুই না বলে পুনরায় অজ্ঞান হয়ে যায় ।
(৩)
নিশার পাপ্পা-মাম্মি তাদের একমাত্র আদরের মেয়েকে দেখতে না পেয়ে প্রায় পাগলের মত অবস্থা । গুলমার্গে ওরা বেশ ভালোই মনোরঞ্জন করছিল । ওরা ওখানকার ঘোড়াতে বসে গাইড নিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছিল । নিশার পাপ্পা প্রায় সময় ওকে নিয়েই ছিল। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে কি যে হয়ে গেল। মেয়েকে দেখতে না পেয়ে ওরা গুলমার্গের লোকাল থানায় যায়। ওরা কিছুই সাহায্য করেনি। সেখান থেকে মিলিটারি ক্যাম্পের জওয়ানদের কাছে যায়। ক্যাম্পের প্রধান মেজরের সাথে কথা বলে ওরা গুলমার্গ থেকে শ্রীনগরে ফিরে আসে। শ্রীনগরে ফিরে এসে ওরা পুলিশ কমিশনারের অফিসে যোগাযোগ করে সব কিছু জানায়। এরপর ওরা মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে। কেউ ওদের আশ্বস্ত করে, আবার কেউ কেউ আশংকা প্রকাশ করে, এই দুইয়ে মিলে এক ধোঁয়াশা পরিস্থিতিতে প্রায় পাঁচদিন শ্রীনগরে কাটিয়ে দিল কিন্তু তাদের একমাত্র মেয়ের কোনো খবরই পেলো না। পুলিশ কমিশনার ওদের বাসস্থান দিল্লীতে ফিরে যেতে বলে এবং আশ্বস্ত করে যেকোনো খবর পেলেই ওদেরকে জানানো হবে এবং প্রতিদিনই ফোন করে জানাবে। ওরাও নিরুপায় হয়ে দিল্লীতে ফিরে আসে ।
(৪)
সুখবীর যাদব বিহারের ছাপড়াতে বাড়ি। ওদের এলাকায় সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র সুখবীর কর্মসূত্রে দিল্লীতে চলে আসে। প্রায় আট বছর দিল্লীর একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করে বেশ ভালো জায়গায় চলে এসেছে। সে কোম্পানীর জোনাল ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্বে আছে। পাঁচ বছর আগে বিয়ে করে রোহিনীকে ... তারপর বছর দুই পরে ওদের কোল আলো করে আসে ওদের একমাত্র আদরের দুলালী নিশা। কোম্পানী থেকে সুখবীরকে সবরকম সুবিধা দিয়েছে। ফ্ল্যাট, গাড়ি সবই... কোম্পানীই ওদেরকে কাশ্মীর ঘোরার সবকিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
কিন্তু গুলমার্গে নিশা নিখোঁজ হয়ে যেতেই ওদের সমস্ত আয়োজন পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। কার্যত হতাশ হয়ে ফিরে আসে দিল্লীতে। ওরা যে আবাসনে থাকে সেই আবাসনের সকলের প্রিয় ছিল নিশা। নিশার নিখোঁজে সকলেই বাকরুদ্ধ । সুখবীর দিল্লী ফিরে এসে কোম্পানীকে এবং দিল্লী পুলিশের ওপর মহল তথা মন্ত্রী লেবেল পর্যন্ত সকলকে জানায় । কিন্তু দশ দিন হয়ে যাওয়ার পরও কোনো ভালো খবর পায়নি। নিশার মা রোহিনী মেয়ের শোকে অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়।
(৫)
রহমান আলি তার বিবিকে নিয়ে অনন্তনাগে তার বড় ছেলের বাড়ি যাচ্ছিল । সেইদিন সন্ধ্যের সময় যাবার পথে নিশাকে রাস্তায় একটি লাশের পাশে পড়ে থাকতে দেখে । নিশাকে তারা ওখান থেকে নিয়ে একটি ক্লিনিকে যায়, ডাক্তার চিকিৎসা করে ওদের ছেড়ে দেয় । পরেরদিনই ওনারা নিশাকে নিয়ে শ্রীনগরে ওদের বসতবাড়ি ডাল লেকে ফিরে আসে । নিশার থেকে ওর বাড়ির ঠিকানা জানতে চায় কিন্তু কদিনের ঘটনায় নিশা একেবারে দিশাহারা, কিছুই বলতে পারে না । তিন বৎসরের নিশা বেশ আতংকে ভুগছে আর পাপ্পা-মাম্মির জন্য কাঁদছে । রাতে ঘুমের ঘোরে ‘পাপ্পা’ আর ‘মাম্মি’ বলে চিৎকার করছে । রহমান আলির বাড়িতে অনেক ছোট ছোট নাতি ও নাতনি আছে, তাদের সাথেও কথা বলছে না । এইভাবে প্রায় দশ-বারোদিন পেরিয়ে যায় কিন্তু নিশার থেকে কোন ঠিকানাই ওরা পায় না। আস্তে আস্তে নিশা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, খেলার সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যায় রহমত আলির নাতি-নাতনিদের, কিন্তু ভাষাগত সমস্যার জন্য ও কাউকে ওর মনের কথা বলতে পারে না। রহমত আলি এবং ওর পরিবারের কাছে নিশা পরম স্নেহে থাকে । একদিন নিশা ওদের মোবাইলে কথা বলতে দেখে আনন্দের সাথে কতগুলো নাম্বার মুখে উচ্চারণ করে। ওরা সাথে সাথেই ওকে জিজ্ঞাসা করে ‘বেটি, ইয়ে কিসকা নাম্বার?’ নিশা অতি কষ্টে ওদের বোঝাতে পারে যে নাম্বারটি ওর পাপ্পার ।
(৬)
সুখবীর যাদব তার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে যদি কোন ফোন কাশ্মীর থেকে আসে । এদিকে রোহিনী অসুস্থ । তাদের একমাত্র মেয়ের জন্য শোকে কাতর । একদিন হঠাৎ একটা ফোন আসে কাশ্মীর পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে । জানতে পারে একটি বাচ্চা মেয়ে এক পরিবারের কাছে আছে কিন্তু তারা মেয়েটির নাম জানতে পারেনি । ওরা মেয়েটির মুখ থেকে নাম্বারটা জানা মাত্রই ফোন করে। নিশার মা রোহিনী মেয়েকে তার পাপ্পার নাম্বারটা কোন এক সময়ে মুখস্থ করিয়েছিল। যার সুফল তারা পেয়েছে অতএব একরাশ আশায় বুক বেঁধে সুখবীর কাশ্মীর পুলিশ কমিশনারের অফিসে ফোন করে এবং বিস্তারিত খোঁজখবর নেয় তারপর রোহিনীকে নিয়ে আবার কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে।
(৭)
কাশ্মীরের পুলিশ রহমত আলির বাড়িতে আসে । তারা এই কদিনে অসাধ্য সাধন করেছে যার জন্য খোদ পুলিশের বড় কর্তাই তাদের বাড়িতে এসেই নিশাকে দেখতে চায়। সুখবীরের কাছে পাওয়া ছবির সাথে নিশার মিল দেখে সকলেই আশ্বস্ত হয়। নিশার পাপ্পা ও মাম্মি কাশ্মীরে পৌছে যায় । তারা তাদের মেয়ের খোঁজে ডাল লেকের রহমত আলির বাড়িতে আসে । সুখবীর ও রোহিনীকে রহমত আলির পরিবার আন্তরিক ভাবে স্বাগত জানায় । মেয়েকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তারা রহমত আলীর পরিবারকে কিছু উপহার দিতে চায়। কিন্তু ওদের পরিবার তা নিতে অস্বীকার করে । নিশাকে তাদের ‘গুড়িয়া বেটি’ সম্বোধন করে । কদিনে ওর প্রতি মায়াও পড়ে যায় । তারা কদিনের জন্য নিশা ও নিশার পাপ্পা-মাম্মিকে ওদের কাছে থাকার জন্য অনুরোধ করে । এরপর সুখবীর, রোহিনী এবং ওদের ‘গুড়িয়া’ নিশা মেহমান হিসাবে প্রায় সপ্তাহখানেক থাকে । ডাল লেকের সৌন্দর্য্য এবং হাউস বোটে কাটানোর স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে । এছাড়াও শ্রীনগরের বিভিন্ন গার্ডেন ‘চশমিশ সাহি’, ‘মুগল গার্ডেন’, ‘শালিমার গার্ডেন’ সহ শঙ্করাচার্্যে র মন্দির সবই প্রদর্শণ করে।
অবশেষে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাকে দুঃস্বপ্ন হিসাবে ভুলে গিয়ে, রহমত আলির পরিবারের সৌজন্যে কাশ্মীরকে আরো সুন্দর ভাবে চিনে ওরা দিল্লীতে ফিরে আসে ।
 
প্রকাশিত - পদক্ষেপ পত্রিকা, চুঁচুড়া, রথযাত্রা সংখ্যা, ২০১৭ 

1 comment: