Sunday, August 26, 2018

অণুগল্প - দাদা ও ডেয়ারী মিল্ক


রাজকুমার ঘোষ -

দাদা ও ডেয়ারী মিল্ক

রাজকুমার ঘোষ / ২১.০৪.২০১৩ / নতুন রূপে ২৬.৮.২০২১

এমনই এক সময় আজ দুনিয়ার সকল মানুষ কাটাচ্ছে, তা আর নতুন করে বলার নেই। জয়িতা আজ মিলানে আছে বছর চার হলো। দু'বছর আগে ঠিক হয়েছিল সে একাই ফ্লাইটে কলকাতায় ফিরবে, দাদা নিতে আসবে এয়ারপোর্টে। কিন্তু সব কিছু ইচ্ছা জলাঞ্জলি মহামারীর চক্করে। এমন ঝাঁ চকচকে শহরের সুদৃশ ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসেও জয়িতার আজ কেমন যেন দিশাহীন লাগে। ইচ্ছা থাকলেও বাড়িতে মা-বাবার কাছে যাওয়ার উপায় নেই। তার একমাত্র প্রিয় অবলম্বন ওর বর সুতপন ভীষণ ব্যস্ত তার মাল্টি ন্যশনাল কোম্পানির ভীষণ ওয়ার্কলোড নিয়ে। বিয়ের পরই বরের সাথে এই অচেনা অজানা ইতালির মিলানে চলে এসেছে জয়িতা৷ আজ তার দাদার কথা বড়ই মনে হয়। সেই তার একমাত্র বোনকে ভীষণ ভালোবাসতো। কারণ ওর বাবা-মা দুজনেই স্কুল টিচার। তাদের প্রচুর ব্যস্ততা ছিল। ওর দাদাই ওর খেয়াল রাখতো সবসময়। ব্যালকনি থেকে আকাশপাণে তাকিয়ে জয়িতা ভাবনার মেঘে হারিয়ে যায় ... "ছোট বোন বলে কথা... আমার আবদার রাখবে না মানে ? আমার প্রিয় ডেয়ারী মিল্ক, চাই! চাই! চাই! ...... এর জন্য কোনরকম কম্প্রোমাইস নয়" .... শুধুমাত্র এই ডেয়ারী মিল্কের জন্য সেই ছোট বেলা থেকে দাদার সাথে কত বেইমানী করেছে জয়িতা। অথচ চাইলেই সে বাবার থেকে পেয়ে যেত। "কিন্ত আমার বোকা হাঁদা দাদা,.. ওঃ ভাবা যায় না, এই ডেয়ারী মিল্ক পাবার জন্য ওকে কত রকম ভাবে ব্ল্যাকমেল করতাম আর ওর থেকে ডেয়ারী মিল্ক হাতাতাম তার ঠিক নেই"। কিন্তু আজ সে দাদার থেকে অনেকদুরে। এখনও ওর ডেয়ারী মিল্ক খুবই প্রিয়। কিন্তু সেটা পাবার জন্য আর কাউকে ব্ল্যাকমেল করতে হয় না। বিনিময়ে এই শহরে ও এমনিই অনেককিছু পেয়ে যায় ওর বরের থেকে। টুকটাক রাগ হলে তা ভাঙানোর জন্য ওর বরই ওকে অনেককিছু এনে দেয়। কিন্তু দাদার সাথে দুষ্টুমি করে ওর প্রিয় ডেয়ারী মিল্ক পাবার মজাটাই আলাদা... আজ জয়িতার বড়ই মনে পড়ছে সে সব দিনের কথা..

ছোট বেলায় বাড়িতে স্যার জয়িতাকে আর ওর দাদাকে পড়াতে আসতেন। দাদা পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল। কিন্তু জয়িতা পুরোদমে ফাঁকিবাজ। দাদা ভাল অঙ্ক করত। এই কারণে স্যার দাদাকে খুব ভালবাসতেন, এর জন্য তিনি প্রায়ই দাদার জন্য ডেয়ারী মিল্ক নিয়ে আসতেন। জয়িতাও পেত, তবে ওই দাদার জন্যই। তবে বিশেষভাবে ডেয়ারী মিল্ক এর প্রতি জয়িতার দুর্বলতা বরাবরই বেশী ছিল। একদিন খুব ফাঁকি দেওয়ার জন্য ও স্যারের কাছ থেকে বেশ বকুনি খেয়েছে। এদিকে ওর দাদাও বেশ ভালো অঙ্ক করেছে, ওকে দেখিয়ে স্যার ডেয়ারী মিল্ক দিল দাদাকে। জয়িতার সহ্য হল না। ফন্দি করে সে দাদাকে মিথ্যেবাদি করে দিল। বলল, ‘স্যার, দাদা কিন্তু বই দেখে করেছে, আপনি ওকে ডেয়ারী মিল্ক দিয়ে ঠিক করেননি’। ওর মুখ থেকে এই কথাটা শোনা মাত্রই স্যার দাদাকে বেধরক ঠ্যাঙালো আর ওকে ডেয়ারী মিল্কটা দিয়ে দিল। এই দৃশ্য জয়িতা আজও ভুলতে পারিনি। অথচ ওর দাদা ওকে কিছু বলেনি। এটা ভেবে ও শুধু কাঁদছে। ওর মনে হচ্ছে, ওর বোকা-হাঁদা দাদাটা শুধু তার বোনকে ভালবাসতে শিখেছে, প্রতিবাদ করতে শেখেনি, শিখলে হয়তো আজ ওকে এভাবে কাঁদতে হতো না। "সরি রে দাদা, আমার এই ভুল তুই ক্ষমা করে দিস"… শুধু কি তাই, দাদার কাছ থেকে স্থায়ীভাবে ডেয়ারী মিল্ক পাবার জন্য ব্ল্যাকমেল পর্যন্ত্য করেছে সে। দাদার সাথে কোচিংএ পড়তো এক বান্ধবী… যাকে জড়িয়ে জয়িতা একদিন দাদাকে বলেই ফেলল “ওর সাথে তোর কিসের সম্পর্ক। তুই ওকে নিয়ে প্রায় বি-গার্ডেন যাস। দাঁড়া, আমি বাবা-মা কে বলে দেব”... ব্যস, এতেই ওর দাদার ঠকঠকানি শুরু। মোটামুটি ইনস্টলমেন্টে জয়িতা ডেয়ারী মিল্ক পেতে থাকত। ওর বোকা দাদা প্রতিবাদ না করে সুন্দর ভাবে মেনে নিয়েছিল। জয়িতার বিয়ের সময় আশীর্বাদে ওর দাদা কাঁদতে কাঁদতে কয়েক বাক্স ভর্তি ডেয়ারী মিল্ক দিয়ে বলেছিল, “আমাকে আর কে জ্বালাতন করবে রে বোন ? নে একেবারে এতোগুলো ডেয়ারী মিল্ক…”। জয়িতার দু'চোখের কোণ দিয়ে অবিশ্রান্ত ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। "ওই দাদা, আজও আমি সেই দিনটা ভেবে খুব কাঁদছিরে"...

আজ জয়িতা কতকিছু পেয়ে যায় অনায়াসেই। সুতপন ভীষণ ব্যস্ত থাকলেও জয়িতার সবই খেয়াল রাখে, কোনোকিছুর অভাব রাখেনি। একটু ছুটি পেলেই এই সুন্দর ইতালির কত কি না-দেখা দৃশ্য দেখাতে উঠে পড়ে লেগে থাকে সে। তারপর এমন সুন্দর এপার্টমেন্টে থাকতো, যেখান থেকে মিলানের সবটাই দেখা যেত। সে তার দাদাকে বহুবার দেখিয়েছে ভিডিওকল করে। ওর দাদা ওকে বলেছে, "হ্যাঁ রে বোন, কি ভাগ্য আমার। তোর জন্যই আমার ইতালি দর্শন হয়ে গেলো"... জয়িতা আজ ভাবছে, "আজ আমাকে কোন ফন্দি করতে হয় না। সবই পেয়ে যাই অনায়াসে৷ না চাইতেই আজ কে এই যে পাওয়া আমার কাছে ভীষণ মধুর, সে ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই । কিন্তু এই মধুর পাওয়াতে কোথায় যেন আমার ক্যাবলা দাদাটা লুকিয়ে আছে।" জয়িতা দাদার সাথে প্রায়ই ভিডিওকল করে৷ এখন ওর স্ত্রী ও ছেলে আছে, কিন্তু তাও যে ওর বোনের প্রতি ব্যকুলতা জয়িতা দেখেছে৷ ওর দাদাটার শরীরটাও ঠিক নেই৷ এইতো কিছুদিন আগেই pancreatic সমস্যায় ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। ও শুধুই ভিডিওকলে দেখেছে। চাইলেও দাদাটার সেবা করতে পারেনি। দাদার কষ্টে ভাগ বসাতে পারেনি। জয়িতা মনেপ্রাণে দাদার সুস্থতা কামনা করছে আর কাঁদতে কাঁদতে দাদাকে বলছে, "দাদা, তুই সুস্থ হয়ে ওঠ, আমি কলকাতায় ফিরলে কোনো ছাড় নেই, আমার ডেয়ারী মিল্ক কিন্তু চাই"। ওর দাদা শুধু বলেছে, "ওরে পাগলী বোন, তুই শুধু আয় রে, তারপর দেখ"৷ জয়িতা মিলানের এই মিষ্টি আকাশপাণে আবার তাকিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করছে, "আজ প্রতিটা ডেয়ারী মিল্ক এর মধ্যে দাদার সরলতা, মিষ্টতা খুব মিস করি … তাই আমার বর যদি ডেয়ারী মিল্ক সহ দাদাটাকেও নিয়ে আসতে পারত, কি ভালো হত তাই না?" একরাশ মনের ভাবনায় জয়িতা ভগবানের কাছে প্রার্থনা করল, "হে ঈশ্বর, দ্রুত রোগ মুক্ত করে দাও এ পৃথিবীর"...

(প্রকাশিত) 

No comments:

Post a Comment