রাজকুমার ঘোষ -
এর আগেও আমি শিক্ষক দিবস নিয়ে লিখেছি। লিখেছি আমার পরম শ্রদ্ধেয়
মাস্টার মশাইদের নিয়ে। তাদের আশীর্বাদ আমার জীবনে কতখানি
প্রভাব বিস্তার করেছিলো সেই নিয়েও বেশ কতগুলো কবিতা এবং গল্প লিখেছি।
আমার জীবনে আমার গৃহশিক্ষক প্রশান্ত মাস্টার মশাইয়ের অবদান
অনেকখানি। এমন এক সময় গেছে যেসময়
আমি অবসাদে ভুগছিলাম। অঙ্কের প্রতি আমার ভীতি ছিল
বা হয়েছিলো। আর এক মাস্টার মশাইয়ের জন্য সেটা হয়েছিলো। মূলত তারই
জন্য আমি অঙ্কর মত বিষয়কে মুখস্থ করতাম। ক্লাস এইটে ভীষণ খারাপ রেজাল্ট
করি। নবম শ্রেণীতে প্রশান্ত মাস্টারমশাই আমার জীবনে ধুমকেতুর মত আসেন। তিনি
আসাতে অঙ্কের প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়ে গেলো। সেই ভালবাসা এখনও অক্ষত আছে।
এখন আমিও আমার ছাত্রদের অঙ্ক করাতে ভালোবাসি। এই তো গেলো আমার পরম
শ্রদ্ধেয় প্রশান্ত মাস্টারমশাইয়ের কথা। এবারে আমি আর একজনের কথা
বলতে চাই যিনি ছাড়া আমার এ জীবন অসম্পূর্ণ। তবে তার আগে আমি গল্পের আকারে
কিছু জানাতে চাই।।
একটি মেয়ে ক্লাস এইট পাশ করতেই তার বাবা-মা
আত্মীয়স্বজনরা তার জন্য সম্বন্ধ
দেখতে শুরু করে দেন। মেয়েটি খুবই ছোট। খেলাধুলার
বয়স। সংসারের নিয়ম নিয়ে কতটুকুই বা জানে। সেই বুদ্ধি তার মধ্যে অতটা গড়ে
ওঠেনি। এদিকে কোনো এক আত্মীয় এক সরকারী চাকরি করা যুবকের সন্ধান পান
এবং মেয়েটির জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। ধুমধাম করে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়।
মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির ফ্যামিলি বেশ বড়। বাড়ির বড় বৌ হিসাবে সেই ফ্যামিলিতে আগমণ।
সেই ফ্যামিলিতে আছে শ্বশুর শাশুড়ী তিন ননদ এবং দুই দেওর। স্বাভাবিকভাবেই
এই ফ্যামিলিতে এসে মেয়েটি দিশেহারা। সংসারের হেন কাজ নেই মেয়েটিকে
করতে হতো না। সে সাংসারিক কাজে অপটু ছিল। সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেই
পরিবারে সকলের গঞ্জনা তাকে শুনতো হতো। শাশুড়ী থেকে ননদরা তাকে প্রায়ই কথা
শোনাত 'বাবা মা কি কিছুই শেখায়নি'। এছাড়াও শাশুড়ীর বিভিন্ন অশ্লীল কটুকথা তাকে
শুনতে হতো। এই ভাবে কেটে গেলো এক বছর। মেয়েটি সন্তান সম্ভাবা হয়ে
পড়লো। দু বছর শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটির কোল আলো করে এলো একটি ছেলে। ছোট্ট ছেলেটি
আস্তে আস্তে এই সংসারে বড় হতে থাকলো। আর দেখতে থাকলো মায়ের প্রতি নানা
গঞ্জনা ও অত্যাচার। ছোট্ট ছেলেটি যখন চার বছর বয়স তাকে নিয়ে তার মা বই নিয়ে
প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসতো। আস্তে আস্তে পরম মমতায় অক্ষরজ্ঞান দিতে থাকলো।
ছোট্ট ছেলেটি সেই অক্ষরজ্ঞানের সাথে প্রথম জ্ঞানের আলো হিসাবে
নিজেকে বিকশিত করতে লাগলো। কিন্তু সংসারের কাজকর্মে ব্যাঘাত হয়। শাশুড়ী মেয়েটিকে
নানা অকথা-কুকথা শোনাতে থাকে। মেয়েটির সহ্যশক্তির সীমা অতিক্রম
করলো একদিন। তার নিজের ছেলের পড়াশোনাতে এত আপত্তির কারণে শাশুড়ীকে সেও দু'চার কথা শুনিয়ে
দিলো। ভয়ংকরী তেজী শ্বাশুড়ী তার বৌমার আচরণ সহ্য করতে পারলো
না। মেয়েটি তখন তার ছেলেটিকে বর্ণ পরিচয় বই পড়াচ্ছিলো। শাশুড়ী সেই সময় একটা
রুটি করার বেলনা নিয়ে মেয়েটির মাথায় সজোরে আঘাত করলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত
ঝরলো এবং সাথে সাথে বর্ণ পরিচয় বইটা রক্তে রাঙা হয়ে গেলো। ছোট্ট ছেলেটি
সেই দৃশ্য দেখে বুঝতে পারলো না কি হল তার মায়ের সাথে। মায়ের আর্তনাদে সে ভয়
পেয়ে গেলো। সে কান্না কাটি করতে লাগলো। সেই বেলনাটা নিয়ে সেও তার ঠাম্মাকে
মারতে উদ্যত হলো।।।।।।।
এই পর্যন্ত গল্পটি থাক। এখানে সেই ছোট্ট ছেলেটি হলো
এই অধম। আমার প্রথম অক্ষর বা বর্ণ পরিচয়ের জন্য আমার মা এর বলিদান আজও মনে
রেখেছি। আমি মনে করি আজ যা কিছু আমার শিক্ষা সবই সম্ভব হয়েছে মা'র জন্য। সেই
প্রতিকুল পরিবেশে আমার মা আমাকে যত্ন সহকারে সেই বর্ণ পরিচয় না দিলে আজ 'আমি' হয়ে উঠতে কখনোই পারতাম
না। আজ আমি স্টুডেন্টদের কমপিউটার শেখাই। টিউশন করি। একটু আধটু সাহিত্য
চর্চা করি সবই আমার মা এর দান। আমি তা ভুলবো কি করে।।।
আজ এই শিক্ষক দিবসের দিনে আমি আমার মাকে প্রণাম জানাই। আমি যতটুকু
জীবনে অর্জন করতে পেরেছি তাঁর অবদান অনস্বীকার্য্য।
----------------------------
এই লেখাটি ২০১৮ বর্ষে শিক্ষক দিবস উপলক্ষ্যে লেখা। তারিখ - ০৬.০৯.২০১৮
অনেকদিন ধরে বুকের মধ্যে জমে থাকা কথা গুলো আজ আমি লিখেই ফেলললাম মা। তোমাকে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলী।
No comments:
Post a Comment