Monday, April 6, 2020

ছোট গল্প- উড়ান



রাজকুমার ঘোষ-

শেঠ পাড়ারনিরালাআবাসনের বিজয়া সম্মিলনীতে এক বিচিত্রা অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ স্বপ্নিল সেন বাবুর অনুরোধ ফেলতে পারেনি স্বপ্নিল বাবু অর্থাৎ সুলেমান স্বপ্নিলের ছোট বেলার বন্ধু আজ ওর যে খ্যাতি তার পেছনে বাবুর অবদান সাংঘাতিক যেভাবে ওকে গাইড করেছে, ওর বাবা-মাও করেনি সেভাবেনিরালাআবাসনের সামনের দিকে বিশাল বড়ো মাঠে জনসমাগম, উপচে পড়া ভীড় আজ সবাই এসেছে ওকে দেখতে এবং সংবর্ধনা দিতে  নিজেকে আজ বিশেষ মানুষ ভাবতে ভীষণ লজ্জ্বা পেলো স্বপ্নিল মঞ্চে ঘোষক এলো, ওর নামের জয়জয়কার
- আমাদের এলাকার গর্ব, স্বপ্নিল সেন আজ শুধু আমাদের এলাকার নয়, সারা বাংলা তথা সারা দেশের গর্ব, যে ভাবে ও সারা ভারতব্যাপীসুর সঙ্গমপ্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করেছে যা এককথায় অসাধারণ আগামীদিনে ওর আরও সাফল্য কামনা করি ইতিমধ্যেই মুম্বাইয়ের বিশিষ্ট সুরকারেরা ওকে দিয়ে তাঁদের আগামী ছবিতে গান গাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন ও আরও এগিয়ে চলুক এখন ওকে বরণ করে নেবেন আমাদেরই আবাসনের বিশিষ্ট ডাক্তার তথা সমাজসেবী বিদ্যুৎ চক্রবর্তী     
নামটা শুনেই চমকে উঠলো স্বপ্নিলতাহলে কি ঋত্বিকা এই আবাসনেরই মেয়ে  
()
ছোট থেকেই স্বপ্নিল গান ভালোবাসতো পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা সেভাবে ছিলনা, কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে ওর বাবা-মা চেয়েছিলো হয় আই.টি.আই বা কোনো টেকনিক্যাল কোর্সে ভর্তি করে দেবে সেই অনুযায়ী ও আই.টি.আই-তে ভর্তিও হয়েছিলো ওর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে কলেজের ফ্যাকাল্টি সুবিমল বাবু ওর বাবাকে জানান –
- আপনার ছেলে কলেজের সোশ্যালে কি অসাধারণ গানটাই না গাইলো
ওর বাবা তো এ কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন
- কি! কলেজে পড়াশোনা না করে গান গাইছে, ঠিক আছে ওর কলেজ যাওয়া বন্ধ!
ওকে সটান বলে দিলো,
- তোর দ্বারা কিছু হবে না, গান গেয়ে কি হবে শুনি? তোকে আর কলেজে যেতে হবে না, কাল থেকে তুই আমার ব্যবসা দেখবি, আর পরীক্ষার সময় শুধু কলেজে যাবি
সেই যে বলা, ওর কলেজ যাওয়া বন্ধ বাবা ও মাকে ভীষণ ভয় পায় স্বপ্নিল একমাত্র ওর বন্ধু বাবু তথা সুলেমান ওর গান নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করতো ওকে কোন জায়গায় গান শেখানো যায় এবং কোথায় কোথায় গান গাইলে ওর নাম-ডাক হবে সেই নিয়ে বেশি ভাবতো ওর বাবা-মাও ঘূণাক্ষরে জানতে পারেনি ওদের এই প্রচেষ্টার কথা
()
ওদের স্টেশনারীর বড় ব্যবসা ছিলো। বেশ নাম-ডাক। কলেজে যাওয়া বন্ধ, কার্যত স্বপ্নিলকে ওদের ব্যবসার জায়গায় বসতে হয়। এক দুর্গাপুজার পঞ্চমীর দিন বেলা নাগাদ কিছু বখাটে ছেলে-মেয়ে ওর দোকানে আসে জিনিসপত্র কিনতে। অনেক কিছু জিনিস কিনে টাকা-পয়সা দেওয়ার সময় ওরা বাজে ব্যবহার করতে আরম্ভ করলো। খেস্তা খিস্তি গালিগালাজ তো ছিলোই, এমনকি আপাত নিরীহ স্বপ্নিলকে ব্যতিবস্ত করে তুলছিলো ওরা। যা দাম, তার অর্ধেক টাকা ধরিয়ে দিয়ে আরও দু-চারটে জিনিস জোর করে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। স্বপ্নিল চিৎকার করতে গেলো, ওদের বাধা দিতে গেলো। এদের দলেরই একটি মেয়ে ঋত্বিকা সাইকেল নিয়ে পালাতে গিয়ে একটা বাইকের সাথে মারাত্মক ভাবে এক্সিডেন্ট করলো। দলের বাকিরা যে যার মত পালিয়ে গেলো, স্বপ্নিল দৌড়ে এসে দেখে ঋত্বিকা রাস্তায় পড়ে আছে, ওর মাথা ফেটে প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে। সাথে সাথেই ওর পরিচিত একজনকে বলে,
-  এই ভাই একটু দোকানটা আমার দেখিস, দেখি এই মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় ভর্তি করা যায়’।
ঋত্বিকার আর জ্ঞান নেই। স্বপ্নিল ঐ অবস্থায় একটা অটো ভাড়া করে ঋত্বিকাকে নিয়ে চলে আসে একটা নার্সিং-হোমে। নার্সিং-হোমের অনেকেই ঋত্বিকাকে চেনে, তাদেরই একজন বললো,
- ডাক্তার বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর মেয়ে, ঋত্বিকা তো! কি ভাবে এক্সিডেন্ট হলো, গুরুতর জখম তো’!
- ঠিক আছে, আগে ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন, ওর বাড়ির লোককে জানান’।
ডাক্তার বিদ্যুৎ চক্রবর্তী এলেন, সব কিছু শুনলেন স্বপ্নিলের কাছ থেকে। স্বপ্নিলকে বললেন,
- তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো, ভাষা নেই। আজকালকার দিনে এই ভাবে কেউ ভাবে না, তার ওপর তোমাকেও ওরা বিরক্ত করেছে, ওর হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি বাবা। ওর মেলামেশা ভালো না। কি যে করি মেয়েটাকে নিয়ে, যাই হোক, তোমার নাম কি বাবা? তুমি কোথায় থাকো?
স্বপ্নিল সবকিছু জানিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছিলো। পরে আর খোঁজ খবরও নেয়নি ও। তবে সুলেমানের থেকে জেনেছে ঋত্বিকা ভালো হয়ে গেছে।
(৪)
এরপর স্বপ্নিলের বাবা ওকে দোকানেও আসতে বারণ করেছে। এই ঘটনার জন্য স্বপ্নিলকেই দায়ী বলে জানিয়েছেন উনি। স্বপ্নিলও আর দোকানে বসেনি। সে এরপর কলেজে কোর্স সম্পূর্ণ করছে তার সাথে গোপনে তার গানের চর্চাও চালিয়ে গেছেএকমাত্র সুলেমানের জন্য ও বিভিন্ন গানের অডিশনে যোগ দিয়েছে। বিভিন্ন জলসা থেকে গান গাওয়ার আমন্ত্রণও আসে। স্বপ্নিল গোপনে সেই সব জলসায় যায়। ওর নাম-ডাকও ছড়িয়ে পড়ে। সুলেমানের সৌজন্যে ও মুম্বাইয়ে যায় সেখানেও সে বিভিন্ন অডিশনে গান গায়। প্রায় বছর দুই মুম্বাইয়ে থাকে। বাবা-মা’র সাথে যোগাযোগ রাখলেও বাবা-মা তাদের ছেলেকে প্রায় ত্যজপুত্র করে দেয়। দু’বছর কঠোর পরিশ্রম করে স্বপ্নিল মুম্বাইয়ের এক মেস বাড়িতে থেকে নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকে। তারপর সারা ভারত ‘সুর সঙ্গম’ প্রতিযোগিতায় নিজের নাম লেখায়। নিজের যোগ্যতার প্রতি বিশ্বাস রেখে সে প্রথম স্থান দখল করে ফিরে আসে বাড়িতে। ওর বাবা-মাও ছেলেকে কাছে পেয়ে ভীষণ ভাবে আপ্লুত। ওরা এখন স্বপ্নিলকে নিয়ে গর্ব অনুভব করে।
(৫)
প্রায় ৫ বছর পর ডাক্তার বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর হাত থেকে সম্বর্ধনা নিচ্ছে ও ডাক্তার বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আজ স্বপ্নিলের সাথে ওর বাবা-মাও এসেছেন বিদ্যুৎ চক্রবর্তী মাইক্রোফোন হাতে বললেন,
- তুমিই সেই ছেলে যে আমার মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছিলে আমি তোমার খোঁজে গিয়েছিলাম তোমার দোকানে, তোমার বাবার সাথে দেখাও হয়েছিলো উনি বললেন, স্বপ্নিল বলে কেউ থাকেনা এখানে, ভীষণ হতাশ হয়েছিলাম বাবা আমার মেয়েও তোমার সাথে অনেকবার দেখা করতে গিয়েছিল, কিন্তু তোমার দেখা পায়নি বাবাআজও সে তোমার প্রতিক্ষায় আছে ভীষণ খারাপ লাগছে তোমাকে বলতে তবুও বলছি, তুমি কি আমার মেয়ের হাত ধরবে বাবা’? দরকার হলে আমি তোমার বাবা-মা এর সাথেও কথা বলবো
স্বপ্নিল জানায়,
- কি বলছেন কাকাবাবু? আমি খুবই সাধারণ ছেলে, পড়াশোনায় ভালো ছিলাম না গানের প্রতি ভালোবাসা ছিল আমার বন্ধু বাবু না থাকলে আমি এই জায়গায় কখনোই আসতে পারতাম না আমি আপনার মেয়ের যোগ্য নই
মঞ্চের আর এক প্রান্ত থেকে মাইকে ভেসে আসে,
- আজ তুমি বিখ্যাত হয়েছো বলে আমি বলছি না, সেদিন যখন আমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল, আমার সব বন্ধুরা সেদিন পালিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু তুমি আমাকে যেভাবে বাঁচাবার জন্য করেছিলে এবং আমি নিজেকে সুস্থ ভাবে ফিরে পেয়ে বারে বারে তোমার খোঁজ করেছি সেদিনই স্থির করে নিই আমার এই জীবনের সকল দায় তোমার তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না  
নিরালা আবাসনের বড় মাঠে রীতিমত কোলাহল শুরু হয়ে গেছে সকলে ঋত্বিকার দিকে তাকিয়ে আছে, এমনকি স্বপ্নিলের দিকেও সবাই তাকিয়ে আছে স্বপ্নিল ভীষণ ভাবে লজ্জ্বা পেয়ে গেলো ওর বন্ধু বাবু পরিস্থিতি সামাল দিতে মাইকে জানালো,
- আচ্ছা, আচ্ছাআমি কাকু কাকিমা মানে স্বপ্নিলের বাবা-মাকে ডেকে নিচ্ছি এ ব্যাপারে তাদের কি মতামত আছে
স্বপ্নিলের বাবা-মাকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল ওর বাবা জানায়,
- আমি আমার ছেলেকে চিনতে পারিনি এ আমার ব্যর্থতা, চিরকালই ওকে আমার পছন্দ মত চলতে বলেছি, আজ ও যা কিছু করেছে, নিজেই করেছে আজ ও নিজেই ওর সিদ্ধান্ত নেবে সেই অধিকার আমি হারিয়েছি
এ কথা বলেই কাঁদতে থাকলেন স্বপ্নিল বলে,
- বাবা-মার আশীর্বাদ সর্বদা ছিলোই এবং এখনও আছে। আপাতত তোমরা এখন আশীর্বাদ করলে আমি ঋত্বিকাকে আমার সহধর্মিনী করতে চাই বাবা
স্বপ্নিলের এই কথা শোনার পর মাঠের সকল প্রান্ত থেকে করতালির আওয়াজে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো মঞ্চে উপস্থিত সকলে, আবাসন ও পাড়ার সকল শুভানুধ্যায়ী মানুষ আজ স্বপ্নিলকে করতালীর ধ্বনিতে আশীর্বাদ জানালো     

প্রকাশিতঃ –
“আমাদের পদক্ষেপ পত্রিকা” ব্লগ ম্যাগ... প্রথম সংখ্যা, থিম – ফিনিক্স... ০৫.০৪.২০২০          

No comments:

Post a Comment