রাজকুমার ঘোষঃ-
(১)
বৈশাখের
মাঝে সূর্য মামার কড়া দৃষ্টি, কলকাতা সহ হাওড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে প্রকান্ড দাবদাহে
সকল মানুষের নাজেহাল অবস্থা । নিতিন বাবুর দশাও তার থেকে আলাদা কিছু নয় । নিতিন
দাস, কলকাতার
বড়বাজারে তার ছাপাখানার ব্যবসা আছে, বেশ রমরমিয়ে তার ব্যবসা চলে । ভীষন কাজে
ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু গত দুদিন ধরে তিনি তার অনেক কাজের চাপ থেকে নিজের
অস্তিত্ত্ব সংকটের লড়াইয়ে বেশি জর্জরিত । সেইজন্য তিনি সব কিছু উপেক্ষা করে শুধু
দৌড়েই চলেছেন। নিতিনবাবুর আজ ভয়ানক বিপদ । তার একমাত্র ছেলে সায়ন আজ পুলিশি
হেফাজতে । ওনার রাতের ঘুম চলে গেছে, খাওয়া দাওয়া নেই বললেই চলে,
ওনার স্ত্রী ছেলের জন্য চিন্তায় অসুস্থ
হয়ে পড়েছেন । পুলিশের কাস্টডিতে থাকা সায়নের ওপর ক্রমাগত অত্যাচার চলছে ।
নিতিনবাবু এই গরমকে চোখে আঙুল দেখিয়ে এক থানা থেকে আরেক থানা,
বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতা থেকে পুলিশের
কর্মকর্তাদের বাড়িতে ছুটে চলেছেন । তার নির্দোষ ছেলের সুবিচার তবু তিনি পাচ্ছেন না
। অনেক কষ্টে তিনি সি.আই.ডির স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার ডি.এম.মিত্তারের খোঁজ পেলেন । একদিন দুপুরের
প্রবল গরমে নিতিনবাবু নিউ আলিপুরের বটতলাতে এলেন । নিউ আলিপুরের এই অঞ্চলে ডি.এম.মিত্তার থাকেন,
ওনার সাথে আপোয়েন্টমেন্ট ঠিক করে
নিতিনবাবু বটতলার স্টপেজে নেমে নতুন পিচে মোড়া বটতলার রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলেন ।
নতুন রাস্তার পিচ-এর গরম আভা নিতিন বাবুকে বেশ ক্লান্ত করে দিল,
অবশেষে ডি.এম.মিত্তারের বাড়ির খোঁজ পেলেন । উনি
মিত্তারের বাড়ির সামনে এসে পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে কলিং বেলে হাত
দিলেন । বাড়ির মেন দরজা খুলে এক সুন্দরী মহিলা ওনার সামনে এলেন এবং ওনার আসার কারণ
জানতে চাইলেন । নিতিনবাবু ডি.এম.মিত্তারের সাথে আপোয়েন্টমেন্ট আছে জানাতে ঐ ভদ্রমহিলা ওনাকে
বাড়ির ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন । বাড়ির গেস্ট রুমের সোফায় নিতিনবাবু কে বসতে বলে
ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন । নিতিনবাবু ঘরের ভেতরের সমস্ত কিছু মন দিয়ে দেখতে
লাগলেন কিছুক্ষণ পরেই মহিলা চলে এলেন ওনার কাছে । নিতিনবাবু ওনাকে বেশ উৎকন্ঠা
নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “যদি মিত্তির সাবকে ডেকে দেন” । ভদ্রমহিলা ওনার বিপরীত দিকের সোফায় বসে বললেন, “হ্যাঁ
বলুন, আমিই ডি.এম.মিত্তার মানে আমার পুরো নাম দিয়া মৌলিনা মিত্র” ।
নিতিনবাবুকে আশ্বস্ত করে দিয়া ওনার
উৎকন্ঠার কারণ জানতে চাইলেন । নিতিনবাবু ওনার সামনে রাখা জগ থেকে এক গ্লাস জল পান
করে বেশ কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে জানালেন, “ম্যাডাম, আমার ভয়ঙ্কর বিপদ । কিছুদিন আগে বাইপাসের
ধারে যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়, সেই খুনে আমার ছেলে সায়নকে পুলিশ
গ্রেফতার করছে । কিন্তু ম্যাম, আমি নিশ্চিত আমার ছেলে এই ঘৃণ্য কাজ কখনোই করতে পারে না । ও
সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করছে । আর যারা অপরাধ করেছে তারা বুক
ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে । আপনি সুবিচার করুন ম্যাডাম । অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে
এসেছি” । এই বলেই কাঁদতে লাগলেন । ম্যাডাম দিয়া ওনাকে জল দিলেন আর
ভেতর থেকে চা আনার জন্য কাজের লোককে বললেন । ম্যাডাম দিয়া নিতিনবাবুর কাছ থেকে
সায়নের সম্বন্ধে জানতে চাইলেন, নিতিনবাবু বললেন সায়ন আইনের খুব ভালো ছাত্র,
কলেজের উঠতি প্রতিভাদের মধ্যে একজন । ওর
অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ত্বের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ত্ব আছে । সেটাই নাকি ওর কাল
হয়েছে । যে মেয়েটি খুন হয়েছে সে সিকিমের মেয়ে, কলকাতায় সেও নাকি আইন নিয়ে পড়াশোনা করতে
এসেছে, কিন্তু
মেয়েটি কলগার্ল হিসাবে নাম করেছে । তিনদিন আগে সায়ন ওর বন্ধুদের সাথে একটি নৈশ্য
পার্টিতে গিয়েছিল, বাড়িতে ফিরেও এসেছিল, পরদিন সকালে বাড়িতে পুলিশ এসে সায়নকে
তুলে নিয়ে গেছে । সব কিছু শুনে ম্যাডাম দিয়া একটি ফোন করলেন,
“হ্যালো, রাহুল… এই তাড়াতাড়ি চলে আয়,
একটা ভাইটাল কেস আছে,
আমাদের কাজ শুরু করতে হবে”
।
(২)
বড়বাজার থানায়
সায়নকে পুলিশ রেখেছে । সায়নকে আলাদা একটি সেলে রেখে দফায় দফায় জিজ্ঞসা করে চলেছে ।
সায়ন চুপচাপ, ওর ওপর পুলিশের অত্যাচার চলছে তবুও সায়ন কিছুই বলেনা । ঘটনাস্থলে
সায়নের একটি লকেট পাওয়া যায় । সেই সূত্রে পুলিশ ওকে ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করে যায় ।
কিন্তু ও জানায় লকেটটি বেশ কিছুদিন আগে হারিয়ে যায়, ওখানে কিভাবে গেল তা জানে না ।
পুলিশ ওর কথায় বিশ্বাস করে না । ভীষন হতাশ সায়ন শুধুই কাঁদতে থাকে । ঠিক সেই সময়
ম্যডাম মিত্র তার সহকারী রাহুল ও ওর বাবা নিতিনবাবুকে নিয়ে এখানে ঢুকলেন। সায়নের ওপর যে অত্যাচার, তার
মুখে ও শরীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা দেখে নিতিনবাবু কাঁদতে লাগলেন । ওখানে উপস্থিত
পুলিশদের সকলকে ম্যাডাম মিত্র জানালেন যে এই কেসটি এখন সি.আই.ডি র হাতে চলে এসেছে,
উনিই এই ব্যাপারে তদন্ত করছেন । ম্যাডাম আলাদাভাবে নিতিনবাবুকে আশ্বস্ত করলেন যে সায়নের জামিনের ব্যবস্থা করবেন । এরপর সায়নের কাছে
ম্যাডাম মিত্র জানতে চাইলেন, এই ঘটনার সাথে ও কিভাবে যুক্ত হল । সায়ন তার মনের সব
কথা ম্যাডাম মিত্রকে ভরসা করে বলে ফেলল, কারণ সে বুঝে গেছে তাকে একমাত্র ম্যাডামই
বাঁচাতে পারেন । এরপর ম্যাডাম মিত্র রাহুলকে নিয়ে মর্গে গেলেন । মেয়েটির লাশটিকে
পোস্ট-মর্টেম করা হয়েছে, সমস্ত তথ্য রাহুলকে সংগ্রহ করে নিতে বলে লাশটিকে ভালো করে
পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন । এছাড়াও মেয়েটিকে হত্যা করার সময় ওর পাশে থাকা জিনিসপত্র
ও মেয়েটির পরনের পোষাক ও শরীরে যা যা গয়না ছিল, সেগুলোর ছবি তুলে নিলেন । ম্যাডাম মিত্র
এরপর সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলেন আর রাহুলকে বিকাল ৩টের পর ওনার বাড়িতে আসতে বললেন
।
বাড়িতে এসে
ম্যাডাম মিত্র তদন্তের সুবিধার জন্য সমস্ত কিছু বিচার বিবেচনা করে ঘটনাটিকে এই
ভাবে গোছালেন...... সায়ন, নিতিন বাবুর
একমাত্র ছেলে । আইন কলেজে ওর সাথে সিকিমের মেয়ে নিলা ভুটিয়ার পরিচয় হয় । বেশ সুন্দরী সিকিমের এই
পাহাড়ী মেয়েটির অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারা সকলকে মোহিত করে । নিলার নীল নীল চোখের
দৃষ্টিতে সায়ন ছাড়া আরও অনেকের রাতের ঘুম চলে গেছিল । নীলা যখন প্রথম কলকাতায় এসে
আইন কলেজে ভর্তি হয়েছিল এই সায়নই নীলাকে সবরকম ভাবে সাহায্য করেছিল । সায়ন নীলাকে খুব
ভালোবাসে । সে নীলাকে কেন খুন করবে ? সায়নের সন্দেহ যায় ওর বন্ধু নিহালের ওপর । নিহাল ত্রিপাঠী, সায়নের সবচেয়ে ভালো বন্ধু । কিন্তু
নীলা চলে যাবার পর আর বন্ধুত্ত্ব রাখতে চায় না, কারণ সায়নের বদ্ধমূল ধারণা নিহালই
হিংসা করে নীলাকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং ওর লকেটটিকে কায়দা করে নিয়ে নীলার
লাশের কাছে ফেলে দিয়েছে, যাতে পুলিশ ওকেই সন্দেহ করে । কিন্তু সায়ন আদৌ ভেবেছিল যে ওর প্রিয় বন্ধু নিহালই
এই কাজ করতে পারে ! নিহালের বাবা একজন নাম করা উকিল । পুলিশকেও সায়ন নিহালের কথা
বলেছে । কিন্তু পুলিশ ওর কথায় পাত্তাই দেয়নি । প্রভাবশালী বাবার ছেলে তো, তাই
নিহালকে কেন পুলিশ বিব্রত করবে ? সায়ন ম্যাডাম মিত্রকে জানিয়েছে যে, বছর চার আগে
যখন নীলা কলকাতায় আসে তখন নীলার ভালোমন্দ সবকিছু ওই দেখত । তখন নিহাল একবার নীলার
সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল, সায়ন নিহালকে সকলের সামনে খুব পিটিয়েছিল । কিন্তু
নিহাল ওর ভালো বন্ধু বলে কলেজের প্রিন্সিপালকে বলেনি । সেই রাগটা নিহাল এতদিন পর সুদে-আসলে
নেবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি । সায়নের ধারনা ওর আর নীলার মেলামেশাকে নিহাল
মেনে নিতে পারেনি ।
কিন্তু এই চার বছরে নিহাল
সবসময় ওদের সাথেই থেকেছে, নিহালের সাথে নীলার সম্পর্ক ভালো হয়ে গিয়েছিল । ওদের সকলের
মধ্যে বোঝাপড়া বেশ ভালোই ছিল । এমনকি ওরা ছুটিতে নীলার বাড়ি গ্যাংটকে গিয়েছিল ।
কিন্তু আজ নীলা চলে যাওয়ায় সায়নের কাছে সব যে মিথ্যা হয়ে গেছে । দুদিন আগে ওরা
সকলে মিলে এয়ারপোর্টে এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিল । ফেরার পথে সায়ন এয়ারপোর্টের
কাছে একটি ট্যাক্সি নিয়ে বেড়িয়ে যায়, নিহাল ছাড়াও আরও ৪-৫ জন ছিল, নীলাকে সাবধানে
হোস্টেলে পৌছে দেওয়ার কথাও তাদেরকে বলেছিল সায়ন । পরদিনই পুলিশ এসে ওর প্রিয় মানুষটিকে খুন ও ধর্ষণ করার অপরাধে ওকে ওর বাড়ী
থেকে তুলে নিয়ে যায় ।
ম্যাডাম মিত্র
ঘটনাটিকে ভেবে নিয়ে এবার তদন্ত শুরু করবেন । ম্যাডামেরও মনে
হয়েছে যে নিহালই হয়ত প্রকৃত খুনী । বিকালে
রাহুলকে আসতে বলেছে এই নিয়ে ওর সাথেও বেশ গুরুত্ত্ব সহকারে আলোচনা
করতে হবে । কিন্তু নীলার এনগেজমেন্ট রিং-টা দেখে ম্যাডাম মিত্র বেশ চিন্তায় পড়ে
গেছেন । তার ওপর রিং-এর মাথায় ইংরেজী অক্ষর ‘N’ আছে । তাহলে কি ‘N’ দিয়ে নিহাল ...... ধুস, নিজেকে একটু থামিয়ে নিল... রাহুলকে একটা ফোন
করল, “এই শোন রাহুল, আমাদের গ্যাংটক যেতে হবে, স্যরকে জানিয়ে দিচ্ছি, তোর ৩টের সময়
আসার দরকার নেই । আজ রাতের ট্রেন ধরতে হবে, তখনই না হয় আলোচনা হবে ।”
(৩)
ম্যাডাম মিত্র স্পেশাল
অনুমতি নিয়ে সেদিন রাতেই গ্যাংটক যাবার ব্যবস্থা করে ফেলেন। রাত ৮টায় শিয়ালদহ থেকে
ট্রেন ধরার ব্যাপার আছে, তাই বেশি ভাবনা চিন্তা না করে রাহুলকে সমস্ত ব্যবস্থা
গুছিয়ে নিতে বলে দিলেন। সায়নের কাছে নিহালের কথা শোনার পর ম্যাডামের নিহালকে
দেখবার খুব ইচ্ছা হয়েছে। তাই নিজে নিহালের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। নিহালের বাড়ি গলফ্গ্রীনে, নিজে ড্রাইভ করে বেশ তাড়াতাড়ি চলে এলেন। বিশাল অট্টালিকার মত বাড়ি দেখে তিনি অবাক হয়ে
গেলেন। নিহালের বাবা অখিলেশ ত্রিপাঠী একজন নাম করা উকিল, বেশ প্রভাবশালী বলা চলে।
বাড়ির সিক্যুরিটিকে নিজের পরিচয় দিতেই দেখলেন অখিলেশবাবু নিজে থেকে ওনাকে
অভ্যর্থনা জানাতে চলে এসেছেন। ম্যাডাম সরাসরি
নিহালের সাথে কথা বলার জন্য অখিলেশবাবুকে বললেন। কিন্তু উনি বারেবারেই অন্য
প্রসঙ্গে কথা বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন । কিন্তু ম্যাডামও বারেবারে নিহালের প্রসঙ্গ
এনে বাধ্য করলেন অখিলেশবাবুকে যাতে নিহালের সাথে কথা বলতে পারে । অখিলেশবাবু ম্যাডামকে গেস্ট রুমে বসতে বলে
নিহালকে ডাকতে গেলেন । খানিক বাদেই ম্যাডাম মিত্র দেখলেন একটা ফর্সা, প্রায় ৬ফুট
লম্বা ছেলে গেস্ট রুম দিয়ে ঢুকল কিন্তু বাড়ির বাইরে চলে গেল। তিনি ধরে নিলেন এই
ছেলে নিহাল নয়, কিন্তু ছেলেটার ডান দিকের ঘাড়ের কাছে ব্যান্ডেজ দেখে একবার ভেবেই
নিয়েছিলেন... আসলে পোস্ট মর্টেম-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, নিলা মরবার আগে নখ দিয়ে মানে
বাঁ হাতের নখ দিয়ে অপরাধীকে আক্রমণ করেছিল... সেই ক্ষত দাগটাই হয়ত ! ...... এইসব
ভাবনার মাঝেই দেখল মোটামুটি চেহারার নিহাল ওনার সামনে হাজির । নিহালকে সরাসরি
জিজ্ঞেস করলেন, নিলাকে কেন সে খুন করল ?... পেছনে অখিলেশবাবুও কখন চলে এসেছেন...
সাথেই সাথেই বললেন, “একথা আপনি বলতে পারেননা ম্যাডাম... কি প্রমাণ আছে যে আমার
ছেলেই একাজ করেছে ? যে করেছে সে তো জেলেই আছে”... তিনি প্রায় ম্যাডামকে হুমকি
দিলেন... নিহাল ওর বাবাকে থামতে বলল ও জানাল, নিলার সাথে এমন কোন খারাপ সম্পর্ক
ছিল না যে ও নিলাকে খুন করবে । কিন্তু ও বিশ্বাস করতে পারছে না যে সায়ন নিলাকে খুন
করবে । নিহাল নিজে থেকেই জানায়
ম্যাডামকে, “আপনি আপনার মত তদন্ত করুন, প্রকৃত খুনিকে অবশ্যই ধরুন, তাতে যদি ও নিজে অপরাধী হয়, শাস্তি
মাথায় পেতে নেবে”।
ম্যাডাম নিহালের বাড়ি থেকে চলে এলেন, এসেই শিয়ালদহ যাবার জন্য
প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন... রাত ৮টায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস-এর এ.সি কোচে বসে রাহুলের
সাথে সবকিছু আলোচনা করে নিলেন । রাহুলের সাথে কথা বলে ম্যাডাম একটা ব্যাপারে
মোটামুটি ভাবে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সায়নের সাথে নিহালকেও এই খুনের ব্যাপারে
অপরাধী ভাবাটা খুব একটা ঠিক হচ্ছে না । যাই হোক, তদন্ত করতে করতে কোন গোলক ধাঁধায়
এসে পরে, সেই ভেবে ম্যাডাম একটা লম্বা শ্বাস নিলেন...
সকালে ১০টায় নিউ জলপাইগুড়িতে পৌছে গেলেন। ড্রাইভার স্টেশনে
অপেক্ষা করছিল, তারপর সেখান থেকে ম্যাডাম ও রাহুলকে তুলে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলল সমতল
ভূমি ছাড়িয়ে পাহাড়ি রাস্তার দিকে... কলকাতার ভ্যাপসা গরমের জ্বালা থেকে খানিক
নিষ্কৃতি... চারিদিকে মনোরম দৃশ্য দেখতে
দেখতে গাড়ি কখন যে রাংপোতে চলে এল খেয়ালই করেনি । রাংপোর চেকপোস্টে ম্যাডামের গাড়ি
দেখে ওখানে উপস্থিত সিক্যুরিটি অফিসাররা ম্যাডামকে অভ্যর্থনা জানালো। ড্রাইভারকে
থামিয়ে রাংপোতে একটু রেস্ট নিয়ে খাওয়া দাওয়া করে আবার যাত্রা শুরু করলেন গ্যাংটকের
উদ্দেশ্যে... গাড়ি যতই এগিয়ে যায় পাহাড়ের অপরূপ শোভা ও মাঝে মাঝে ছোট ঝর্ণার ধারা,
মায়া মেশানো কুয়াশা সবকিছু মিলে দুজনকে বিভোর করে তোলে। গোটা সিকিমই পাহাড়ের মাঝে
অবস্থান করছে, চোখ জুড়ে যায় যেদিকেই তাকানো যায়... ড্রাইভার বিকাল হওয়ার ঠিক আগে
ওদের নিয়ে চলে এল এন.এইচ রোডের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে হোটেল কি-সেল-এর
দোরগোড়ায়... বেশ ঝাঁ চকচকে হোটেল থেকে ম্যানেজার ও বয় বেরিয়ে এল, ওদের অভ্যর্থনা
জানিয়ে হোটেলের মধ্যে নিয়ে গেল... ওদের দুটি রুম দেখিয়ে দিল। ম্যাডাম-এর রুমটি তিন
তলায়, বেশ সুন্দর সাজানো-গোছানো, জানালা খুললেই দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের
মিলনমেলা... সূর্যের আলোতে একটি পরিস্কার শৃঙ্গও দেখা যাচ্ছে, হোটেল বয়কে জিজ্ঞাসা
করতেই জানতে পারলো শৃঙ্গটি কাঞ্চনজঙ্ঘার... সার্থক এই হোটেলে আসা, মোবাইল
ক্যামেরায় এই দৃশ্যটি বন্দি করে নিল... ম্যাডামের মনে পড়ে গেল বছর ৮ আগে বাবা-মা
এর সাথে গ্যাংটকে আসার স্মৃতিগুলো, তখন গ্যাংটকে এসে পেলিং, রাবংলা, ছাঙ্গু, বাবা-ধাম,
জিরো পয়েন্ট... ভাবতে ভাবতেই একটা মেসেজ ঢুকলো ম্যাডামের সেলে... এই মেসেজটা
আসতেই ম্যাডাম বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন... “কি ব্যাপার গ্যাংটকে গেছেন তদন্ত
করতে............” ... একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে এই মেসেজটি এসেছে, রাহুলকে ওর
রুমে আসতে বলল আর নাম্বারটি সম্বন্ধে খোঁজ নিতে বলল ।
ঠিক সন্ধের মুখে রাহুলকে নিয়ে ম্যাডাম বেড়িয়ে পড়লেন নিলার
বাড়ির খোঁজে... নিলার বাবার দোকান আছে লাল মার্কেটে, সেখানে গিয়ে দেখলেন যে ওদের
দোকানটা বন্ধ আছে। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানলেন গত ক’দিন ধরেই ওদের দোকান বন্ধই আছে। তারপর
ওরা সকলকে জিজ্ঞাসা করে নিলার বাড়ি পৌছে গেল। ছোট বাড়ি দেখতে হলেও বেশ সাজানো গোছানো ... ওর বাবা-মা দু’জনেই আছে। নিলার মৃতুর খবর
জেনে ওরা কার্যত ভেঙে পড়েছে, ম্যাডাম এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা মাত্রই সমস্ত রাগ
উগরে দিল সায়নের ওপর... এমন কি সায়নের মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করে ফেলল । ওদের বদ্ধমূল
ধারনা, খুনটা যে করেছে তাকেই জেলে আটকে রেখে ঠিক করেছে । কিন্তু ম্যাডাম নিহালের
কথা বলতেই নিলার বাবা-মা ওকে জামাই বলে উল্লেখ করল। নিলা যখন সবাইকে নিয়ে গ্যাংটকে
বেড়াতে এসেছিল, তখনই নিহাল নিলাকে ওর বাড়ির সকলের সামনে বিয়ের প্রস্তাব দেয় এবং নিলার
আঙুলে নিজের নামের আদ্যক্ষর ‘N’ এনগেজমেন্ট
রিং পড়িয়ে দেয়। আর সায়নকে নিহাল ও নিলার শ্ত্রু বলে বার বার বলতে লাগল। কারণ সায়ন
নিলাকে পায়নি, সেই আক্রোশে সে তাদের
মেয়েকে খুন করেছে।
ম্যাডাম মিত্র
আর কথা না বলে ওদের স্বান্তনা দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে এলেন... ফিরে এলেন হোটেল
কি-সেল এ... আসার সময় এম.জি. মার্গ-এ এক ঘন্টা বসে ছিলেন, এখানে বসে যেন একটু
শান্তি পেলেন... রাহুলের সাথে দরকারি অনেক কিছু আলোচনা করে নিলেন। এম.জি. মার্গ
থেকে হোটেল মাত্র ১০ মিনিট । তাই নির্বিঘ্নে হোটেলে এসে গেলেন, তারপর ম্যাডাম নিজের
রুমে ঢুকে জানালা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করবেন কি আরেকটা মেসেজ ঝাক্কাস
রিংটোন নিয়ে ওনার সেলে এন্ট্রি করল । মেসেজে লেখা আছে, “আর কেন ম্যাম, ঘরের ভালো,
সুন্দর মেয়ে... ঘরেই থাকুন না, কি হবে এইসব নোংড়া ঘাঁটাঘাঁটি করে”...। রাহুলকে
নিজের রুমে আসতে বললেন, মেসেজটা দেখালেন... গ্যাংটকে এসে প্রকৃত খুনি সম্বন্ধে
জানা না গেলেও নিহাল যে নিরাপরাধ সেটা বোঝা গেল... কিন্তু মেসেজটি আসার পর থেকেই
ম্যাডাম মিত্র বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন... রাহুলকে বললেন, “আগামিকালই আমাদের ফেরার
ট্রেন ধরতে হবে রাহুল... তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর
(৪)
গ্যাংটকে নিলার পরিবারের সাথে দেখা করে ম্যাডাম সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি যে নিলাকে কে খুন করেছে ! এখানে এসে জানতে পারেন নিলার সাথে নিহালের বিয়ে হয়েছে যে
কিনা ম্যাডামের সন্দেহের তালিকায় প্রথম দিকে ছিল । এদিকে পুলিশের কাস্টডিতে থাকা সায়নকেই নিলার পরিবার প্রকৃত খুনি ভাবছে । একটা অদ্ভুৎ ধোঁয়াশার পরিস্থিতি নিয়ে ম্যাডাম গ্যাংটক থেকে ফিরে এলেন । গ্যাংটকে থাকাকালীন ম্যাডামের মোবাইলে হুমকির এস.এম.এস এসেছে । এই এস.এম.এস পাঠানোর ব্যক্তিটি কে ?... রাহুলকে খোঁজ নিতে বলেন । গ্যাংটক থেকে
ফিরে এসে সকালে ম্যাডাম নিউ আলিপুরে নিজের বাড়ির চেম্বারে বসে
গভীর চিন্তায় ডুবে ছিলেন, রাহুল এসে জানায় কালিঘাটের কোনো এক
ব্যক্তির নাম্বার থেকে এই এস.এম.এস এসেছে । পুলিশ সেই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে কালিঘাট থানায় রেখেছে । সাথে সাথেই
ম্যাডাম রাহুলকে নিয়ে কালিঘাট থানায় চলে এলেন । যাকে গ্রেপ্তার করেছে,
সে পঁচিশ বৎসরের যুবক, খালাসির
কাজ করে । পুলিশ তাকে এস.এম.এস পাঠানোর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাতে সে জানায় তার মোবাইল গত
দু’দিন আগে চুরি হয়ে গেছে । আরও জানায় সেদিন রাতে জুয়ার আড্ডা থেকে মোবাইলটা পাওয়া যাচ্ছে না, সেই আড্ডায় ওর সাথে আরও ছয়জন ছিল । ম্যাডাম তাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নিয়ে একটা তালিকা তৈরি করে রাখলেন ।
কালিঘাট থানা থেকে ম্যাডাম বেরিয়ে গিয়ে সেদিন দুপুর থেকেই ওনার মিশন শুরু করলেন । মনে ভীষণ জেদ চেপে গেছে যে করে হোক খুনিকে খুঁজে বের করবেনই । থানায় ওই
যুবকের কাছ থেকে পাওয়া ছয়জনের তালিকা
ধরে কাজ শুরু করে দিলেন । নিজে গেলেন একজনের খোঁজ করতে কিন্তু তাতে কোন সুরাহা হল না
। ম্যাডাম নিজের জানাশোনা ক’জনকে ওই
তালিকা ধরে খোঁজ করতে বললেন এবং প্রত্যেককে ওদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে এবং তার ছবি তুলে রাখার নির্দেশ দিলেন ।
সন্ধ্যের সময়
ম্যাডাম সকলের কাছ থেকে প্রায় একশ’র বেশি ছবি সংগ্রহ করে নিজের অফিসের ল্যাপটপে
বসে খুব মন দিয়ে দেখছিলেন... কালুয়া নামে একজনের দুটো ছবিতে ম্যাডাম আটকে গেলেন ।
ঐ ছবি দু’টিতে কালুয়ার সাথে থাকা একজনকে খুব চেনা চেনা মনে হয়েছে... একটু ভাবতেই
তিনি ছেলেটিকে চিনে ফেললেন । ঐ ছেলেটিকে তিনি নিহালের বাড়িতে দেখেছেন । প্রায় ৬ ফুট
লম্বা, ফর্সা ছেলেটি সেদিন গেস্ট রুম দিয়ে ঢুকে বাড়ির বাইরে চলে গেছিল, কিন্তু
ছেলেটার ডান দিকের ঘাড়ের কাছে ব্যান্ডেজ দেখে তিনি বেশ আশ্চর্য্য হয়েছিলেন, পরে
যদিও তিনি সেই নিয়ে ভাবেননি । কিন্তু
এই মুহুর্তে তিনি ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন... আসলে পোস্টমর্টেম-এর রিপোর্ট অনুযায়ী,
নিলা মরবার আগে নখ দিয়ে মানে বাঁ হাতের নখ দিয়ে অপরাধীকে আক্রমণ করেছিল... সেই
ক্ষত দাগটাই হয়ত কাজে লাগতে পারে । ভাবামাত্রই তিনি রাহুলকে ফোন করে জানালেন পুলিশ
নিয়ে সে যেন মহাবীরতলার বস্তি এলাকায় চলে যায়, কারণ কালুয়া মহাবীরতলার বস্তি
এলাকায় থাকে যেখানে ওর চোরাই মদ, জুয়া ও সাট্টার ঠেক আছে এছাড়াও
কালুয়ার বিভিন্ন অসামাজিক কাজকর্মে যুক্ত থাকার খবর আছে । পুলিশের খাতায় কালুয়া একটি দাগি নাম । ম্যাডাম যথারীতি প্রস্তুতি
নিয়ে কালুয়ার আড্ডাতে চলে যান, সেখানে গিয়ে দেখেন কালুয়ার সাথে আরও চারজন
বসে বেশ মজলিসে মেতে আছে ।
কালুয়া
বাকিদের বলে,
“চিয়ার্স...! লে লে পি পি... আজ অঙ্কুবাবুর থেকে বহুত পয়সা পিটেছি”... ম্যাডাম
ঢুকেই বলে, “আমায় হিস্সা দিবি না, বেশ তো এস.এম.এস করছিলিস” । একথা শুনেই কালুয়া ও
তার সাথীরা বেশ চমকে গেল এবং ম্যাডামকে আক্রমণ করতে গেল । ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্টার ম্যাডাম
দিয়া মৌলিনা মিত্র মূহুর্তের মধ্যে কালুয়ার সাথীদের ধরাশায়ী করে দিলেন । সাথীরা যে
যার মতো চারপাশে লুটিয়ে পড়ল আর একটা জুতসই প্যাঁচে কালুয়াকে বেকায়দায় ফেলে দিয়ে বলল, “কিরে হিস্সাটা দে?”... তারই মাঝে রাহুল পুলিশকে নিয়ে সেখানে চলে এসেছে । কালুয়াকে
গ্রেফতার করে ভ্যানে নিয়ে তোলা হল ।
ঠিক এইসময়ে ম্যাডামের সেলফোন বেজে উঠল । মোবাইলে কথা বলার পর ম্যাডাম বেশ উৎকন্ঠা নিয়ে রাহুলকে বললেন, “বড়বাজার
থানা থেকে ফোন করেছে...একটা বাজে খবর আছে”...
(৫)
মহাবীরতলায় কালুয়ার ঠেক
থেকে ওকে গ্রফতার করে যখন পুলিশের ভ্যানে তুলে দেওয়া হয়, ঠিক তখনই বড়বাজার থানা
থেকে ম্যাডামের কাছে ফোন আসে। ম্যাডাম রাহুলকে জানায়, নিহাল সুইসাইড করেছে, ওকে
টালিগঞ্জের কাছে একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। নিহাল একটি চিঠিতে লিখেছে,
সায়নকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়, আর এই খুনের জন্য সে নিজেকে দোষী বলে উল্লেখ করেছে। গভীর
চিন্তামগ্ন হয়ে ম্যাডাম রাহুলকে বললেন, “রাহুল, তুই এই জানোয়ারকে কালিঘাট থানায়
চালান কর, আমি বরং বড়বাজার হয়ে নিহালের কাছে যাই, দেখি কোথাকার জল কোথায় গড়ায়...”
এরপর ম্যাডাম মিত্র বড়বাজার থানায় চলে আসেন, সেখানে সায়নের বাবা নিতিন দাসও ছিলেন,
ছেলের মুক্তিতে তার চোখে মুখে তৃপ্তির ছোঁয়া... ম্যাডাম সায়নকে সবকিছু জানালেন,
নিতিনবাবুকে বাড়ি যেতে বলে তিনি সায়নকে নিয়ে চলে এলেন টালিগঞ্জের নার্সিংহোমে,
যেখানে নিহাল ভর্তি আছে। ম্যাডাম এসে দেখলেন নার্সিংহোমে নিহালের বাবা অখিলেশ
ত্রিপাঠী উপস্থিত আছেন। ম্যাডামকে দেখেই, “ম্যাডাম মিত্র, আপনি কিন্তু আমার সাথে খুব
খারাপ করলেন, এইভাবে আমার ছেলেকে ভয় দেখিয়ে ওকে এই অবস্থায় আনার জন্য আপনাকে ছেড়ে
দেব না... মনে রাখবেন আমার নাম অখিলেশ ত্রিপাঠী... জানেন না আমি কি করতে পারি,
দুয়া করুন আমার ছেলে যেন ঠিক হয়ে যায়... তা নাহলে আপনাকে আর এই ছেলেটাকে (সায়নকে
দেখিয়ে) ......” ম্যাডাম উত্তেজিত হয়ে, “জাস্ট... সাট্ আপ...!, তদন্ত এখনো শেষ
হয়নি মি. ত্রিপাঠি”... এই বলে ম্যাডাম সায়নকে নিয়ে নিহালের কেবিনে গেলেন, নিহালের
খানিকটা চেতনা এসেছে... ও মৃদু গলায় জানায়,
একটু ঠিক আছে, সায়নকে দেখে ওর দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ল তারপর সায়নকে কাছে
টেনে বুকে জড়িয়ে ধরল... কেবিন থেকে ম্যাডাম মিত্র বাইরে বেরিয়ে এসে অখিলেশ
ত্রিপাঠিকে বললেন, দেখুন, “কে কাকে ছাড়ে... একবার ভেতরের দৃশ্যটা দেখে আসুন, আপনার
ছেলে খুনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে...... আর শুনুন, আপনি এখানেই থাকবেন, আমি মাত্র
তিন’ঘন্টার জন্য আসছি, এখান থেকে এক পাও নড়বেন না”... ম্যাডাম ফোন করে কিছু
পুলিশকে আগেই আসতে বলে দিয়েছিলেন, তাদেরকে আদেশ করলেন, “এই মহান মানুষটা
(মি.ত্রিপাঠিকে দেখিয়ে) যেন এখান থেকে কোথাও না যায়, আমি তিন ঘন্টা পর এখানেই আসব”
... এই বলে সায়নকে নিয়ে তিনি কালিঘাট
থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। সেখানে
গিয়ে দেখলেন যে একেবারে দক্ষযজ্ঞ অবস্থা... কালুয়াকে বেশ উত্তম মধ্যম দেওয়া হচ্ছে
। রাহুলের কাছে ম্যাডাম জানতে চাইলেন, কালুয়া কিছু বলেছে কিনা... রাহুল জানায়,
ওঙ্কারনাথ শর্মা, নিহালের বন্ধু... সেই কালুয়াকে দিয়ে হুমকির এস.এম.এস গুলো
করিয়েছে... কিন্তু খুন ও ধর্ষনের ব্যাপারে কিছু জানায়নি। এরপর ম্যাডাম কালুয়ার
কাছে গিয়ে দু-চার ঘা লাগিয়ে বলে, “দেখ কালুয়া, তুই আর কি কি জানিস বলে দে, খুব
বাজে ভাবে ফেঁসে গেছিস... তুই কিছুতেই এই গ্রহচক্র থেকে বেরোতে পারবি না... তোর
প্যায়ারের লোক ওঙ্কারনাথও তোকে ছাড়াতে পারবে না। ভালোয় ভালোয় সব বলে দে...! তার
আগে বল ওঙ্কারনাথ কি এখন ওর বাড়িতে থাকবে?” ... কালুয়া জানায় “থাকবে”... সায়নও
ওঙ্কারনাথকে চেনে, সে জানায়, সেদিন এয়ারপোর্টে যে পার্টিতে ওরা গিয়েছিল, সেটা
ওঙ্কারনাথরই বার্থ ডে পার্টি ছিল। সায়ন ভেবে অবাক হয়ে যাচ্ছে যে, নিলাকে সম্পূর্ণ
প্ল্যান করে খুন করা হয়েছে... অথচ নিহাল ও ওর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে।
এরপর সেখান থেকে ম্যাডাম
মিত্র রাহুল ও সায়নকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এয়ারপোর্টের দিকে... সাথে কিছু
পুলিশকেও নিয়ে নিলেন। পথে যেতে যেতে সায়ন জানায়, নিলার লাশের কাছে যে লকেট পাওয়া
গেছে, সেটা ওর, একদম ঠিক কথা, লকেটটা ও নিহালের বেডরুমের টেবিলে ফেলে আসে। কিন্তু
সেটা লাশের পাশে কিভাবে আসতে পারে ... এই বলে ভীষণ অস্থির হয়ে যায়। ম্যাডাম মিত্র
ওকে আশ্বস্ত করে জানায়, “আগে আগে দেখো ভাইয়া, হোতা হে ক্যায়া..”। ওরা পৌছে গেল
ওঙ্কারনাথের বাড়ি... বিশাল ব্যাপার... বাড়ির সাথে লাগোয়া বিরাট গার্ডেন, একটি
স্যুইমিং পুল... ওঙ্কারনাথ সেখানেই ছিল... ওদের সকলকে দেখে কেমন যেন ভড়কে গেল...
বিশেষ করে সায়নকে দেখে... সায়নকে বলল, “আরে ভাই, সায়ন... কনগ্রাচুলেশন, খুন করনেকে
বাদভি তু রেহা হো গ্যায়া.. জিও জিও ... ক্যায়া হোগা ইস দেশকা”... ম্যাডাম মিত্র
বললেন, “কালুয়ার প্যায়ারের অঙ্কুবাবু... দেশের কি হবে জানিনা, কিন্তু তোর যে কিছু
একটা হবে সেটা তুই জেনে রাখ”......... “ক্যায়া মতলব”... ওঙ্কারনাথ উত্তেজিত হয়ে
বলতেই... রাহুল জানায় “চল কালিঘাট থানায় কালুয়ার সাথে তোকেও বেশ খাতিরদারি করব”...
ওঙ্কারনাথ সেখান থেকে পালাবার চেষ্টা করতেই সায়ন ওকে ধরে এক থাপ্পর কষায়, ম্যাডাম
মিত্র তারপর ওঙ্কারনাথের চুলের মুঠি ধরে পুলিশের জিপে তোলে তারপর সেখান থেকে
সরাসরি টালিগঞ্জের নার্সিংহোমে নিয়ে চলে আসে।
(৬)
ম্যাডাম তার কথা অনুযায়ী
তিন ঘন্টার অনেক আগেই নার্সিংহোমে চলে আসেন এবং সাথে ওঙ্কারনাথকে নিয়ে আসতে দেখে মি.
অখিলেশ ত্রিপাঠী রীতিমতো হতবাক । ম্যাডাম মিত্র বললেন, “কি মি. ত্রিপাঠী?... আপনার এই স্পেশ্যাল
সাথীকে দেখে চমকে গেছেন মনে হচ্ছে। এবার দেখবো কে কাকে ছাড়ে...” ... মি. ত্রিপাঠি
বেশ রেগে, “কি যা তা বলছেন, ও তো আমার ছেলের দোস্ত আছে, আমার পার্টনার কেন হতে
যাবে” ... ম্যাডাম মিত্র ওনাকে একটু সবুর করতে বললেন, তারপর শুরু করলেন, “যেদিন
আমি প্রথম আপনার বাড়িতে নিহালের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, ঐ দিন আমি অপেক্ষা
করছিলাম আপনার গেস্ট রুমে, আপনি নিহালকে ডাকতে গেলেন, তখনই আমি ওঙ্কারনাথকে দেখি,
ওর ডানদিকের ঘাড়ের কাছে ব্যান্ডেজ দেখেও আমি ভাবিনি যে এই হল আসল শয়তান... আর একটা
ব্যাপার খেয়াল করেছিলাম যে, এই ওঙ্কারনাথ যখন বেরিয়ে এল ও কিন্তু আপনার ছেলে রুম
থেকে বেরিয়ে আসেনি। কারন গেস্টরুম থেকে নিহালের ঘরটা পরিস্কার দেখা যায়। তারপর ওঙ্কারকে
দেখার পর আমি ঠিক হয়ে গেলাম যে, ওই ছেলেটি আর যাই হোক নিহালের কাছে আসেনি... কারণ
ছেলেটির ধরন দেখে মনে হয়নি যে ও সমবেদনা জানাতে এসেছে, যাই হোক, আমার কথা হল,
সেদিন ওঙ্কারনাথ নিশ্চয়ই আপনার সাথে দেখা করতে এসেছিল। আর সায়নের লকেটটা আপনিই
ওঙ্কারকে দেন”... মি. ত্রিপাঠি প্রায় ভিমৃ খাবার অবস্থায়, সাথে সাথে চেল্লিয়ে ওঠে,
“দেখুন ম্যাডাম, আপনি বহুত বারাবারি করছেন”... ম্যাডাম মিত্র, “বেশি কথা বললে, এই নার্সিং
হোমের বাইরে যে ডোবাটা আছে দেখতে পাচ্ছিস, সেখানে তোকে চুবিয়ে মারব ত্রিপাঠি... জাস্ট চুপ করে শুনে যা......
সবচেয়ে বড় কথা আজ তোর ছেলে নিহাল কেন সুইসাইড করতে গেল, ও জানে নিলাকে কে খুন করেছে... তোর সাথে তোর এই
পার্টনারের কথা নিহাল শুনেছে... তারপর ও সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে... জিজ্ঞেস
কর সায়নকে, ওর বন্ধু নিহাল ওকে কি বলেছে, ... ভাই সায়ন, এই দুই শয়তানকে বলোতো, আসল সত্য...”
সায়ন বলল, “নিহাল আমার কাছে হাত জোড় করে জানিয়েছে, আমাকে তুই ক্ষমা করিস বন্ধু,
বিনা অপরাধে তোকে এই কদিন থানার লক-আপে থাকতে হল আর পুলিশের অত্যাচার সহ্য করতে
হল... আমি জানি নিলাকে কে খুন করেছে? কিন্তু সেটা বলতে পারবো না বলেই সমস্ত
দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে আমি মরতে চেয়েছি, আর নিলার সাথে আমিও চলে যেতে চাইছি...
নিলাকে ছাড়া কি হবে বেঁচে থেকে...” ম্যাডাম মিত্র, “এবার আপনি কি বলবেন, মি. অখিলেশ
ত্রিপাঠি... আমি বলব নাকি আপনাদের মধ্যে কেউ বলবেন, আর এই শয়তানটাকে (ওঙ্কারকে
গিয়ে টেনে এক থাপ্পর দিয়ে) ফাঁসির দড়িতে দেখতে চাই...” ... এবার ওঙ্কারনাথ,
“ম্যাডাম... ম্যাডাম... হামি আপনাকে সব বলব, প্লীজ আমাকে ছেড়ে দেবেন তো” ... “আগে
তো বল, তারপর না হয় ভাবা যাবে”... ওঙ্কারনাথ বলার আগেই মি.ত্রিপাঠি ম্যাডামকে একটু
সাইডে নিয়ে গিয়ে, “কি দরকার আছে, শুনুন ম্যাডাম মিত্র, নিজেদের মধ্যে ব্যাপার
আছে... একটু মিটমাট করে নিলে হয়না... আমার ছেলেও ঠিক হয়ে যাবে... প্লীজ ম্যাডাম আর
জলঘোলা করবেন না... কেসকে এখানেই ফিনিস করে দিন...” ... ম্যাডাম একটা সপাটে থাপ্পর
দিয়ে দিল মি.অখিলেশ ত্রিপাঠি কে, “তুই তো দেখছি মহা জানোয়ারের নানা আছিস... তোর
সাহস হয় কি করে, একটা নিস্পাপ মেয়েকে খুন করে আবার মিটিয়ে নিতে বলছিস... তোর এই
কথাও আমি আমার মোবাইলে রেকর্ড করে নিয়েছি... এবার বল ঠিক কি কি করেছিস সায়নকে
ফাঁসাবার জন্য...” নেহাত বাধ্য হয়েই
মি.অখিলেশ ত্রিপাঠি এবার শুরু করলেন, “আমি নিহালের বেডরুম থেকে লকেটটা নিয়ে
ওঙ্কারনাথকে দিই, নিহালের সাথে আমি নিলার সম্পর্ক কখনোই মেনে নিতে চাই নি, এক
পাহাড়ি মেয়ে আমার ছেলের বউ হতে পারে না...তাই নিলাকে সরানোর রাস্তা নিই... কায়দা
করে আমি ওঙ্কারনাথকে রাজি করাই, ওর নিলার প্রতি একটা আকর্ষন ছিল... যেদিন ওরা ওঙ্কারের
পার্টি থেকে বেরিয়ে এল, ওঙ্কার সেই সুযোগে পার্টি থেকে বেরিয়ে ওদের ফলো করে...
নিলাকে যখন ওর হোস্টেলের সামনে ছেড়ে ওরা চলে যায় তখন ওঙ্কার কালুয়ার সাথে কিছু
সঙ্গীকে নিয়ে নিলাকে তুলে নিয়ে বাইপাসের ঐ ফাঁকা জায়গায় নিয়ে চলে আসে, তারপর ওকে
খুন করে”... ম্যাডাম মিত্র এরপর ওঙ্কারনাথের তলপেটে সজোরে লাথি মেরে, “এরপর তুই
নিলাকে ধর্ষন করে নৃশংস ভাবে খুন করিস আর সায়নের লকেটকে সেখানে ফেলে আসিস যাতে
সায়নকে পুলিশ ধরে ... ছিঃ ছিঃ... তোকে ফাঁসিতে ঝোলাবোই......! ব্যাস আর কিছু বলার
দরকার নেই... সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেছে...” এবার এখানে মজুত পুলিশদের ও রাহুলকে ম্যাডাম
মিত্র বলেন, “এদের নিয়ে শ্রীঘরে যা... ভালো করে ওদের দেখাশোনা করুক আমাদের
ডিপার্টমেন্ট”... রাহুল আর অন্যান্য পুলিশ ওঙ্কারনাথ ও মি.ত্রিপাঠিকে নিয়ে চলে
গেল... ম্যাডাম এবার সায়নকে নিয়ে নিহালের কেবিনে গেল, দুই বন্ধুকে পাশাপাশি দেখে ম্যাডামও
একটু তৃপ্তির হাসি নিয়ে বলল, “নিলাকে এবার আমি ভীষণ মিস করছি, তোমাদের মাঝে যদি
থাকতে পারত... কিন্তু ও আজ যেখানেই থাকুক না কেন, বেশ তৃপ্তি ও শান্তিতে আছে এটা
বলতে পারি”... এই বলে ম্যাডাম সেখান থেকে বেরিয়ে গেলেন। নিহাল ও সায়ন ম্যাডাম দিয়া
মৌলিনা মিত্রর চলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
প্রকাশিত - 'আমাদের লেখা' প্রথম সংখ্যা,২০১৪ থেকে ষষ্ঠ সংখ্যা, ২০১৫ পর্যন্ত ধারাবাহিক গল্প হিসাবে প্রকাশিত।
সব রকমের লেখাতেই তুমি খুব সাবলীল । খুব ভালো লিখেছ, দারুণ লাগলো
ReplyDeleteথাংক ইউ চন্দ্রাবলী... তোমাদের মূল্যবান প্রশংসা আমাকে আরো লেখাতে উৎসাহিত করবে।
ReplyDeleteপ্রশংসনীয় লেখা।খুব মনযোগ দিয়ে পড়লাম।Crime জগৎ টাই এধরণের হয়।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ স্যার
DeleteReally best
ReplyDeleteপড়েছিস তুই
Deleteশুরুটা দারুণ
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ
Deleteমাইন্ড ব্লোইনগ গল্প 😬😬
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ সো মাচ।
Delete