রাজকুমার ঘোষ -
সাল ১৯৮৭, যে সময় ক্লাস ফোর পাস করে ফাইভে ভর্তি হওয়ার জন্য আমার বাবা
চেষ্টা করছিলেন । আমিও প্রাইমারী থেকে হাই স্কুলে যাবার জন্য পরীক্ষার
প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । এক শুভানুধ্যায়ী
দাদু বাবাকে পরামর্শ দিলেন যে আমাকে হোস্টেলে পাঠানো হোক । বাবা সেই
অনুযায়ী আমাকে উলুবেরিয়ার একটি হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন । হোস্টেল সংলগ্ন
কল্যানব্রত স্কুলে আমি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তী হয়েছিলাম । আমি আমার জীবনের
একটা বৎসর ক্লাস ফাইভে ওই হোস্টেলে কাটিয়েছিলাম । ক্লাস ফাইভে পড়তাম, বয়স
অনুযায়ী আমি খুবই ছোট, সেই সময়কার চোখ দিয়ে শিক্ষক দিবসের যে পূর্ণাঙ্গ রূপ
আমি দেখেছিলাম তা এককথায় অনবদ্য । ভাষায় তা ব্যক্ত করা যায় না ।
শিক্ষক দিবসের আগের দিন আমাদের হোস্টেলের স্যর তথা ইনচার্জ রণজয় মাস্টার
মশাই আমাদের হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বললেন যে, ‘স্কুল মাঠে শিক্ষক দিবস
উপলক্ষ্যে একটা বিরাট মেলা বসবে, সবাই যে যার মতো করে আনন্দ করো, টাকা পয়সা
বুঝে খরচা করো’ । তিনি অনেকগুলো ছয় সদস্যের টিম করে দিলেন । এক একটা টিমে
ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত্য প্রতি ক্লাসের একজন করে ছিল । ক্লাস
টেনের সিনিয়র দাদাদের প্রত্যেকটি টিমের ক্যাপ্টেন করে দিলেন । তিনি
প্রত্যেক ক্যাপ্টেনকে টিমকে সঠিক ভাবে পরিচালনা করার কড়া নির্দেশ দিলেন
আর টাকা পয়সা ঠিক ভাবে খরচ করার দায়িত্ত্ব এবং অবশ্যই সমস্ত খরচের হিসাব
করে জমা দেওয়ার নির্দেশও দিলেন । আমিও কোনো একটা টিমের অন্তর্ভূক্ত হয়ে
গেলাম । ক্লাস ফাইভে পড়তাম তাই আমিই হলাম সেই টিমের সব চেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য ।
আপাততঃ ক্লাস টেনের দাদাই হল আমার অভিভাবক । তার আদেশ আমাকে মানতেই হবে ।
এমনিতেই আমার লালুভুলু চেহারার জন্য আমাকে আমার সিনিয়র দাদারা খুবই
ভালোবাসতো ।
পরের দিন মানে শিক্ষক দিবসের দিন সকাল ৯ টায় আমাদের
স্কুলের বড় মাঠে গিয়ে দেখি বেশ বড় করে মেলা বসে গিয়েছে । দারুন জমজমাট
ব্যাপার । চারিদিকে দেখি ছোট ছোট করে বিভিন্ন রকম স্টল বসে গেছে । একটা
রেস্টুর্যান্টও বসেছে দেখলাম । ওই ছোট ছোট স্টলের কোথাও আলুর দম, কোথাও
ফুচকা, ঘুঘনি, এছাড়াও কোথাও মাটির পুতুল, খেলনার জিনিসও আরো কত কি আছে ।
আমার সিনিয়র দাদার নির্দেশে সকাল ৯ টার মধ্যেই আমি তৈরী হয়ে মেলা প্রাঙ্গনে
চলে এসেছিলাম । এরপর আমরা টিমের ছয় জনেই প্রথমে মাটির তৈরী জিনিসের স্টলে
ঢুকলাম । যিনি বিক্রি করছিলেন তাকে দেখে তো চমকে যাবার জোগার, ইনি আর কেউ
নন … আমাদের অঙ্কের মাস্টারমশাই গোবিন্দবাবু । যিনি আমাদেরকে সাদর আমন্ত্রণ
জানালেন । আমাদের পছন্দের মাটির জিনিস দেখালেন । আমরা কতগুলো মাটির মূর্তি
কিনে নিয়ে ওনাকে পয়সা দিয়ে বেরিয়ে ঘুঘনির স্টলে ঢুকলাম । যথারীতি সেখানেও
চমক, আমাদের বাংলা শিক্ষক সমিরবাবু । উনি আমাদের কাছে জানতে চাইলেন,
‘বাবুরা, মুড়ি দিয়ে ঘুঘনি খাবেন নাকি ?’। আমি তো শুনেই হো হো করে হেসে
ফেললাম । উনি আমাকে আদর করে গালটা টিপে দিলেন । ওনার কাছে মুড়ি-ঘুঘনি খেয়ে
পয়সা দিয়ে চলে গেলাম । আমরা দেখি আমাদের হিন্দী শিক্ষক বেলুন বিক্রী
করছিলেন, আমরা সবাই একটা করে বেলুন কিনে নিলাম । সব চেয়ে বড় চমক বোধ হয়
আমাদের জন্য ভীষণ ভাবে অপেক্ষা করছিলো যখন আমরা ফুচকার স্টলে ঢুকলাম ।
দেখলাম ফুচকাওয়ালার বেশে আমাদের হিটলার রূপী রণজয় মাস্টারমশাই । ওনার কাছে
যেতেই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক’টাকার ফুচকা দেবো খোকাবাবু ?’ আমি ওনার
এই সম্বোধন শুনে বেশ অবাক হয়ে যাই । ওনাকে আমি খুব ভয় পেতাম । উনি খুব কড়া
প্রকৃতির মাস্টারমশাই ছিলেন, এছাড়াও আমাদের হোস্টেলের মেন অভিভাবক ছিলেন ।
একটু কিছু ভুল হলেই উনি শাস্তি দিতেন, মারধোরও করতেন । ওনার নামটা দারুন
ভাবে স্বার্থক, সত্যিই একা যুদ্ধে জয় করা নায়ক, শুনেছিলাম উনি সেনাতে
ছিলেন, অবসর নেবার পর উনি স্থির করেছিলেন একটা আশ্রম করবেন, তা তিনি
করেছিলেন, এই কল্যানব্রত স্কুলের সাথে তার এই আশ্রম ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে গেছে
... সেই স্বপ্নের উদ্দেশ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র কান্ডারী... এই যে মেলা,
সমস্ত পরিকল্পনা ও তার আয়োজন ওনার মস্তিস্কপ্রসূত, শুধু ছাত্র নয় এই
আশ্রমের সাথে যুক্ত সকলেই ওনাকে বেশ সমীহ করত, ওনার নিয়ম ছিল বজ্রের মত
কঠিন, কোন ব্যাপারে উনি সিদ্ধান্ত নিলে তা চূড়ান্ত হিসাবেই গণ্য হত ...
কিন্তু আজ উনি কি সুন্দর সকলের সাথে কথা বলছিলেন । উনি সবাইকে ফুচকা দিলেন,
আমি তো তিনটের বেশি ফুচকা খেতে পারছিনা বলে উনি আমাকে আরো ফুচকা নেবার
জন্য অনুরোধ করছিলেন । এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমরা আরো স্টলে ঢুকলাম ।
সব স্টলেই আমাদের স্কুলের কোন একজন টিচার অবশ্যই ছিলেন । বেলায় আমরা রেস্টুর্যান্টে গিয়ে মাংস-ভাত খেয়ে নিলাম । দারুন একটা দিন আমরা বেশ উপভোগ
করলাম । খুব মজা নিয়ে সারাটা দিন আমরা সকলে মিলে একসাথে কাটালাম । ২০১০
সালে আমি শিক্ষক দিবসের দিন সেই স্মৃতি দিয়ে ঘেরা স্কুলে গিয়েছিলাম...
কিন্তু সেই মহামিলন আর হয় না... কারণ এই মহামিলনের স্রষ্টা রণজয়
মাস্টারমশাই স্কুল থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন... উনি যে আশ্রমে থাকতেন সেই
আশ্রমের ঠিকানা সংগ্রহ করে ভীষন মনমরা হয়ে চলে আসি । আমি আশ্রমে গিয়েছিলাম
মাস্টারমশাই-এর সাথে দেখা করতে... দেখলাম বয়স ওনাকে চেপে ধরেছে, কিন্তু
ওনার গলার আওয়াজে দেখলাম সেদিনও বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠেছিল । ওনার কাছে
গিয়ে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, “চিনতে পারছেন স্যর”... উনি মুচকি
হাসলেন, “লাল টুপি পরা আর সবুজ মেরুনের শোয়েটার গায়ে সেই বাচ্চা ছেলেটা
আমাকে প্রণাম করতে এসেছিল, আর আমি তাকে কড়া করে বকে দিয়েছিলাম... সেই
ছেলেটার কি কান্না”... সেদিন ও উনি প্রণাম নিলেন না । উনি বলেন “ইশ্বর আছেন
তাকে বাদ দিয়ে আবার আমি কেন ?” ... আমি কিছু বললাম না, চোখের কোন দিয়ে
প্রবল ধারায় জল বেরিয়ে যাচ্ছে... ইচ্ছে হলেও আমি সেই জল মুছতে পারলাম না
...
আজ ২০১৬ সালে শিক্ষক দিবসের দিনে আমি আমার সেই দিনের কথা
ভাবছি । এইরকম একটা অভিনব উপায়ে শিক্ষক দিবস আর ফিরে আসবে না । আমি খুব
ভাগ্যবান যে এমন একটা অসাধারণ মিলন মেলায় উপস্থিত ছিলাম । যাকে বলে
ছাত্র-শিক্ষকদের মহামিলন মেলা । আমার মতো আর কেউ এই ধরনের মিলন মেলা শিক্ষক
দিবসে পালন করেছে কিনা কে জানে ? সেই পূণ্যদিনটার কথা স্মরণ করি প্রতি
শিক্ষক দিবসে, আর চোখের কোন দিয়ে জল নেমে আসে । আমার শ্রদ্ধেয় হিটলার রুপী
রণজয় মাস্টার মশাই এই জগতে আর নেই । তার সেই স্নেহ, ভালোবাসা কেন জানিনা
আজও আমার সাথে বয়ে বেড়াচ্ছে । মহামিলনের সেই দিনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম উনি
আমাদের কতখানি ভালোবাসেন । আজ উনি যেখানেই থাকুন না কেন, প্রাণভরে আমাদের
সকলকে আশীর্বাদ করছেন ।
প্রকাশিত - "আবুলিশ" পত্রিকা, জানুয়ারী ২০১৭
No comments:
Post a Comment