Sunday, September 9, 2018

গল্প - আসল দুর্গা মা



রাজকুমার ঘোষ - 

মিত্তির বাড়ির ঐতিহ্য আজ হয়তো সেভাবে নেই । সময়ের প্রবাহে এই আধুনিক জগতের ঘনঘটায় আজ শুধু মিত্তির বাড়ি হয়েই ঠেকেছে । গ্রামের শেষ ও শহরের শুরু এমন সহাবস্থানেই মিত্তির বাড়ির ভিত গড়েছিলেন কয়েক পুরুষ আগের জমিদার রাজনারায়ণ মিত্তির, তার দাপট ছিল বেশ । এই স্থানের সকলে তাকে সমিহ করে চলত । শোনা যায় ব্রিটিশরাজ তাকে রাজবাহাদুর সম্মানে ভূষিত করেছিল । তার আমল থেকেই বাড়িতে চলে আসছে দুর্গাপূজা, পূজার চারদিন গ্রামের প্রত্যেকের নিমন্ত্রণ থাকত । সেই ধারা বংশানুক্রমে তার পরিবারের পরের পুরুষেরা বজায় রেখে চলেছে । রাজন্য মিত্র সেই পরিবারের হাল ধরে আছেন এখনো পর্যন্ত্য, ইতিহাসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সে এই পরিবারের দুর্গাপূজা পালন করে চলেছে নিষ্ঠার সাথে, এবারেও তার ব্যতিক্রম নয় । সপ্তমীর দিনে বাড়িতে অনেক লোকের সমাগম, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই তাদের পূজার সাথে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহন করছে । বাড়িতে উৎসবের মহল তৈরি হয়েছে কিন্তু তার মনে যে কোন আনন্দ নেই । সে বিষন্ন চিত্তে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে একা বসে আছে ।

রাজন্য মিত্র তার পিতা ও ঠাকুর্দার পথ অনুসরণ করেই বড় হয়েছেন । তিনিই হলেন এই বংশের একমাত্র ডাক্তার । তার দাদু ও বাবার ইচ্ছা অনুসারে তিনি ডাক্তার হয়ে এই গ্রামের মানুষের সেবার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছেন । তিনি গ্রামের মানুষের কাছে ভগবানের মত, তাদের সুখ দুঃখের সাথি । অথচ তার ছোটবেলা সেভাবে কাটেনি । স্কুলের পড়ার সময়ই এক মর্মান্তিক পথ দুর্ঘটনায় তিনি তার বাবা ও মাকে হারান । তার দেখাশোনার ভার গ্রহন করেন তার অবিবাহিত পিসিমা নিলিমা মিত্র । শুধুমাত্র রাজন্য মিত্রর দায়ভার গ্রহন করার জন্য নিলীমাদেবী এই পরিবারের স্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন । সেই সময় নিলীমা দেবী রাজন্য মিত্রর দেখাশোনা ছাড়াও জমিদারি ও পারবারিক ব্যবসার সমস্ত কিছু নিজের মত করে বুঝে নিয়েছিলেন । ছোট রাজন্য মিত্রকে বড় করে তুলে তাকে ডাক্তার করার পেছনে নিলীমা দেবীর অবদান অনস্বীকার্য্য । সময় বয়ে যায় রাজন্য মিত্র বড় হয়ে বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়ে গ্রামের মানুষের দেখাশোনা করতে থাকেন । রাজন্য মিত্রর বিয়ে হয় শহরের এক ধনিঘরের মেয়ের সাথে । কিন্তু সেই মেয়ের সাথে নিলীমা দেবীর সংঘাত হতে থাকে । রাজন্য মিত্র তার ডাক্তারি ও জমিদারি দেখাশোনার জন্য এই সংঘাতের বিন্দুবিসর্গ কিছুই টের পাননি ।

প্রতি বছর তাদের বাড়িতে চিরাচরিত দুর্গাপূজাও ধুমধামের সাথে পালন করেন তিনি তার পিসি নিলীমাদেবীর আশীর্বাদে তিনি গ্রামের মানুষের সাথে এই পূজার চারদিন দারুন আনন্দ করেন । কিন্তু এ বছর তিনি সমস্ত দায়িত্ব পাড়ার হাতে দিয়ে বাড়ির ছাদের চিলে কোঠা ঘরে একা বসে আছেন, কারণ তার পিসিমা নিলীমাদেবী তার সাথে নেই । দুমাস আগে তার পিসি তাকে, “খোকা, তোর তো অনেক দায়িত্ব আমি নিয়েছি, এবার আমাকে মুক্তি দে বাবা... শহরের অনতিদূরে একটি বৃদ্ধাশ্রমে আমাকে দিয়ে আয় বাবা... তোর পরিবার আছে, তোর ছেলে ও মেয়েও তোর সাথে আছে, তুই কিছু ভাবিস না”...
এই কথাশুনে রাজন্য মিত্র বলেছেন, “মাগো তুমিই তো আমার জগদ্ধাত্রী, তোমাকে ছাড়া আমি তো শূণ্য... আমাকে ছেড়ে তুমি চলে গেলে আমি থাকব কি করে মা, ছোট থেকে আমিই তো তোমাকে আমার দুর্গামা হিসাবে দেখে আসছি, সে বাড়িতে যতই দুর্গা প্রতিমা আসুক না কেন, তুমি যেও না মা...
সে তুই বুঝবি না খোকা, একটা সময় আসে যখন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয়, আমারও সেই সময় উপস্থিত... আমার মন বড়ই চঞ্চল । সংসারের মায়া আর ভালো লাগছে না । তুই কি আমার এই কথা শুনবি না বাবা... আমাকে দিয়ে আয় বৃদ্ধাশ্রমে, ওখানে আরো অনেকেই আছে যাদের সাথে থেকে আমি আমার এই বয়সটা কাটাতে চাই, তুই তোর মায়ের এই শেষ ইচ্ছাটা পুর্ণ করবি না ?...”
রাজন্য আর কথা না বাড়িয়ে তার পিসিমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছেন । তার মনে হয়েছে যে বাড়িতে দুর্গাপূজায় তার আরাধ্য মা যখন নেই তো কিসের এই দুর্গাপূজা । কি জন্য এই ধুমধাম, সে তার স্ত্রীকে এই ব্যাপারে বলেছে কিন্তু তার স্ত্রী তার এই ভাবনার ব্যাপারে কিছুই বলেনি, এড়িয়ে গেছে বলা যায় । বাড়ির কর্মাচারীদের থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন আজ এই পরিস্থিতির জন্য তার স্ত্রী একমাত্র দায়ী কিন্তু তিনি তার স্ত্রীকে কিছুই বলতে পারছেন না । অথচ তার দুর্গামা রূপি পিসিমাও তাকে তার স্ত্রীর সম্বন্ধে কিছু অভিযোগ জানায়নি । নিঃশব্দে তিনি এই পরিবার থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন ।
চিলে কোঠার ঘরে বসে রাজন্য মিত্র তার পিসি তথা তার দুর্গা মায়ের কথা ভাবছেন আর চোখের জলে নিজেকে রাঙিয়ে নিচ্ছেন এই সময় বাড়ির সদর খানায় একটি কোলাহল হচ্ছে । তার ছেলে রোহনের গলা শুনতে পাচ্ছেন তিনি, “বাবা... বাবা... দেখো কে এসেছেন, আজ সপ্তমীর দিনে আমাদের বাড়ি আলো করে আমাদের মা এসেছেন ... সত্যিকারের দুর্গা মা এসেছেন । ওরে কে কোথায় আছিস, শঙ্খ বাজা... বাবা কোথায় গেলে তুমি, তুমি বরণ করে নাও তোমার মাকে

রাজন্য বাবু ছুটে চলে আসেন বাড়ির সদর খানায় দেখেন সত্যিই তো তার বাড়ি আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন তার জগদ্ধাত্রী, তার দুর্গা মা নিলীমা দেবী । রাজন্য মিত্র কাঁদতে কাঁদতে তার পিসির পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন । নিলীমা দেবী রাজন্য মিত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওরে পাগল ছেলে, তুই কবে বড় হবি বাবা, এখনো বাচ্চাদের মত কাঁদে

রাজন্য মিত্র এবার বেশ আনন্দ সহকারে বাড়িতে দুর্গাপূজার সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন । তার যে আসল দুর্গা মা চলে এসেছে এবং এই বংশের পরম্পরা অনুসারে তার ছেলেও যে সেটা অনুভব করেছে । আজতো খুশির দিন । আগামী চারদিন রাজন্য মিত্র তার আত্মিয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী এবং তার দুর্গা মা রূপি পিসীমাকে নিয়ে বেশ আনন্দর সাথে এই খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে আছেন ।

প্রকাশিত - আমাদের লেখা শারদ সংখ্যা, অক্টোবর, ২০১৬  

1 comment: