Saturday, September 15, 2018

ছোট গল্প - ফেলে আসা সে দিন

রাজকুমার ঘোষ -
দুটো মারাত্মক স্ট্রোক হয়ে রঞ্জনবাবুর নড়বড়ে অবস্থা । রিটায়ার হবার দু’বছরের মধ্যেই তিনি বেশ বুড়ো হয়েছেন সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝেগেছেন । তিনি পুরোপুরি প্রতিমার ওপর নির্ভরশীল । প্রতিমাই তার একমাত্র  অবলম্বন । ছত্রিশ বছর ধরে একটি মসৃণ পথ দিব্যি কাটিয়ে এসে এই দু’বছরে প্রতিমাকে কেমন অচেনা লাগে । সবসময় মুখ ঝামটা দেয়, কথায় কথায় ধমক দেয় ...সাথে প্রতিমার ছেলেটাও এখন বেশি কথা বলেনা । কাছেই আসে নাতো, কথা ! বাবা বলেও ডাকেনা । অথচ দু’বছর আগেও কি খাতির । এখন নিজের শ্বশুরই ওর আপন বাবা । আজ সরস্বতী পূজা, বাড়িতে পূজা হয়, প্রতিমাই সব কিছু তদারকি করছে । রঞ্জনবাবু তার টলমলে পা  নিয়ে কোনরকমে বারান্দায় একটি চেয়ার নিয়ে বসে আছেন আর রাস্তার ওপর অগণিত লোকের যাওয়া আসা দেখছেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আজ মা বাসন্তির আরাধনার দিনে এক গাল হাসি নিয়ে ফূর্তি সহকারে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগই জোড়ায় জোড়ায়, এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে তাদের এই খুশির দিন। রঞ্জনবাবু মনেমনে বিড়বিড় করলেন, “তবুও ভাল...প্রতিমার মুখ ঝামটার থেকে এই কচিকাচাদের মুখের হাসি ঢের ভালো”। এরপর তার চোখ চলে গেল রাস্তার পাশেই পুকুরের পাড়ে বসার জায়গায়, যেখানে একটি ছেলে ও মেয়ে নিজেদের মধ্যে কি বলছে ছাই বোঝা যায় না, আর বোঝার দরকারও নেই... কিন্তু ছেলেটা মেয়েটাকে জাপটে ধরে... ছিঃ ছিঃ ... অসভ্যতারও সীমা নেই, কি দিনকাল...! রঞ্জনবাবু বিরক্তি নিয়ে চোখটা দ্রুত সেখান থেকে সরিয়ে নিলেন.. পুকুরের আর এক পাশে দুটি নারকেল গাছ দাঁড়িয়ে, তাদের ছায়া পুকুরের খানিকটা জায়গায় ছড়িয়ে আছে, সাথে রোদ্দুরের ছটা মায়াবি রূপ ধারণ করেছে... সেই দিকেই তাকিয়ে রঞ্জনবাবু পিছিয়ে গেলেন ফেলে আসা সেই দিনটায়-------------- 

সেদিনও ছিল সরস্বতী পূজা, সকালে পুস্পাঞ্জলী দিয়ে সে অলকের সাথে রূপেন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি বেরিয়েছিল। তারপর খগেনকাকার চায়ের দোকানে বসেছিল, 
অলককে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তুই ঠিক বলেছিস তো,... ও, এই রাস্তা দিয়েই যাবে ?” 
... “আমি তো দেখলাম ওরা পাঁচজন আসছে”... 
“মনে হয় আসছে, চুপটি করে বসে থাক, একটাও কথা নয় কিন্তু”... 
“এইভাবে আর ক’দিন রে রঞ্জন, তুই ওকে ভালোবাসিস, সেটা ওকে বলে দে”... 
“এই চুপ কর, আমি যদি নাই বলি, তাতে তোর কিরে, ও জানে আমি ওকে ভালোবাসি” 
“হাতির মাথা জানে, আমি নেই তোর সাথে” এই বলে অলক রাগ করে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল
“এই রাগ করিস না লক্ষীটি” ... অলকের হাতটা ধরে  “তুই দেখে নিস, আজ ঠিক বলবই”  
“ দেখা যাক...!  তোর দৌড় জানা আছে”... 
দূর থেকে দেখা যাছে সবার মাঝে সব চেয়ে মিষ্টি মুখের প্রতিমা আসছে এই রাস্তা ধরে, রঞ্জন প্রতিমার চলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে... প্রতিমা একটিবারের জন্য ওর দিকে ঘুরেও দেখল না । 
অলক বলল, “কি নবাব পুত্তুর..! এই ভাবে চলবে তো...? ”    
রঞ্জন মুচকি হাসল তারপর সেখান থেকে রূপেন স্যার এর বাড়িতে চলে এসেছিল। রূপেন স্যারের বাড়িতে রঞ্জনরা পড়তে আসত, প্রতিমারাও আসত। প্রতিমা শ্যামল বর্ণের হলেও অসামান্য সুন্দরী, মুখের মধ্যে কেমন যেন মায়া, আর চোখদুটি যেন তীক্ষ্ম, কিন্তু মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। শরীরের গড়ন যেন কবির চোখে একটি একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা। শুধুই চেয়ে দেখার মত।  রঞ্জন শুধু বিভোর হয়ে তাকিয়েই থাকত। প্রতিমাই মেয়েদের দলের মধ্যে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। রঞ্জন, ওর ভালোবাসা কোন ভাবেই প্রতিমাকে জানাতে পারে না। বন্ধুরা খুব টিটকিরি দিত, কিন্তু ও হেসে উড়িয়ে দিত। রূপেন স্যারের বাড়িতে সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে প্রতিমা ও রঞ্জনের একটি গীতি-আলেখ্য পাঠ ছিল । খুব সুন্দর অনুষ্ঠানটি হওয়ার পর খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। মেয়েরা সব খেতে বসে গিয়েছিল, আর ছেলেরা পরিবেশন করছিল। গরম খিচুরি পরিবেশন করার ভার ছিল রঞ্জনের, সে যখন প্রতিমাকে দিতে গিয়েছিল, শ্যামল মেয়ের মিষ্টি মুখে সেই মুগ্ধতায় মাখানো গভীর চোখের দিকে বিভোর হয়ে তাকাতেই বিপত্তি... প্রায় এক হাতার গরম খিচুরি ওর হাতে ঢেলে দিয়েছিল। প্রতিমা চেল্লিয়ে ওঠে... রঞ্জন ভীষন ভয় পেয়ে সেখান থেকে ছুটে রাস্তায় চলে এসেছিল। রাস্তায় এসে তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিছুক্ষন পরেই প্রতিমা সেখানে আসে, রঞ্জন বেশ ভয়ে জড়সড় হয়ে ওকে বলেছিল, 
-- "আমি ভুল করেছি, আমার এই ভুলের কোন ক্ষমা নেই। তুমি যা শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেব। 
--- "ভুল তো তুমি করেছই, নিজের মনের কথা না বলে, ভাগ্যিস এই গরম খিচুরি ছিল... 
এই বলে প্রতিমা সেখান থেকে ছুটে চলে গেল। রঞ্জন বোকার মত তখনও কেঁদে যাচ্ছিল।------------ 
  
--- “কিগো, কি হল তোমার, কাঁদছ কেন ? - রঞ্জনবাবু প্রতিমার হাত ধরে কাঁদতে থাকে, বলে, তুমি আমাকে আর ভালোবাসো না... শুধুই বকো” ...  
--- “একি!  বুড়ো বয়সে আদিখ্যেতা দেখ... চলো, তোমাকে ধরে নিয়ে যাই ... বারান্দায় বসে ঠান্ডা লেগে যাবে তো নাকি” ... 
এরপর আরো ধমকের সুরে বলেন, 
--- “কথা তো শুনবে না...! ঘরে গিয়ে শুইয়ে দেব, ঘুমিয়ে পড়বে কিন্তু, বাজে চিন্তা করবে না” ... 
রঞ্জনবাবু এই ধমকের সুরেই প্রতিমার ভালোবাসা দেখতে পেলেন বোধ হয়, তাই শুধু বল্লেন, “আচ্ছা”... 
প্রকাশিত - আমাদের লেখা রথযাত্রা সংখ্যা' ১৮ জুলাই, ২০১৫

No comments:

Post a Comment