রাজকুমার ঘোষ -
“তোর যদি হিম্মত থাকে, তো একটা বাড়ি করে দেখা, আর পারলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে
যা”... বাবার কাছে এই কথাটা শুনে রঞ্জন ভীষণ আঘাত পেয়েছে । গত তিন দিন ধরে
ওর বাড়িতে অশান্তি চলছে । ও নিজের কাজ
নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সংসারের ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামায় না । কিন্তু ওর বৌ
রমার সাথে বাবার ঝগড়ার মাঝে ও এসে পড়েছে । ও কিন্তু বলেছিল, “তোমাদের এই
অশান্তি ভালো লাগেনা, তার চেয়ে এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়া ভাল”... এরপর ঐ
কথাটা ওর বাবা একবার নয়, বারবার বলেছিল... সেদিনের মত ওর খাওয়া আর হল না । ও
ওর ছেলে সোনাকে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল । ৫ বছরের ছেলে সোনা তার বাবার
কাছে ঘুমোবে, রঞ্জন ওকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, আর তাতেই ঘুমিয়ে পড়বে ।
ছেলে বাবা অন্ত প্রাণ । রঞ্জনও সোনাকে একেবারে কাছছাড়া করতে চায় না । সেদিন
রঞ্জনের চোখে ঘুম আসে না । সোনাও আজ বাবাকে ছাড়াই নিজে ঘুমিয়ে পড়েছে । আজ
রঞ্জন না খেয়েই ছিল, তার ওপর ওর শরীরটাও ক’দিন ধরে ভালো যাচ্ছিল না । বাবার
ঐ কথাটা ভাবতে ভাবতে ও বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করল, ওর যেন মনে হল সমস্ত
জগৎ হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে । ওর কাছে সব কিছু অন্ধকার......, কিছুই ঠাহর করতে
পারছে না । ওর পাশেই ছিল সোনা, সোনাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু খুঁজেই
পেল না । এক গভীর কালো অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে খুঁজে না পেয়ে চিৎকার করতে
যাবে কি, চোখের সামনে কেমন যেন মায়ায় ঘেরা এক জগৎকে দেখতে পেল, সে একটু পা
বাড়াতেই দেখতে পেল, এক ধোঁয়াশাময় দুনিয়ায় আরো কত মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে
আছে । কে যেন ওর হাতটা ধরে ঐ লাইনে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল । লাইনের শুরুতে
দেখতে পেল এক থুড়থুড়ে বুড়ো একটা বিরাট লম্বা খাতা নিয়ে কি যেন হিসাব করছে ।
আর ঠিক তার পেছনে শিংওলা মুকুটপড়ে এক ভদ্রলোক বসে আছে । সে এক একটা লোককে
নিয়ে এসে কি জিজ্ঞাসা করছে আর অট্টহাস্যে চারপাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে । ওর কাছে
সব কিছু কেমন অদ্ভুত মনে হতে লাগল । শেষমেশ লাইন ধরে ও এসে পৌছল মুকুটধারী
লোকটির কাছে । পৌছেই ও লোকটিকে প্রশ্ন করল, “কি ব্যাপার, আমি এখানে কেন ?
আমি ছেলের কাছে তো ছিলাম”... লোকটি বিকট হাসিতে জানাল, “তুই তোর সব মায়া
ত্যাগ করে এখানে এসেছিস, বুঝতে পারছিস না ?... ওরে পাগল, মরে গেলে তো আমার
কাছেই আসতে হয়”... এই কথা শুনে রঞ্জনের মাথাটা ঘুরে গেল । সে করুন আর্তি
জানায়, তাকে ছাড়া সোনা কি ভাবে থাকবে, আর সেইবা কি ভাবে থাকবে , এই বলে সে
প্রচন্ড কাঁদতে লাগল । মুকুটধারী লোকটি ওকে বোঝালো, নিয়ম অনুযায়ী রঞ্জন
এখানে এসেছে, সুতরাং সোনাকে ছাড়া এখানেই থাকতে হবে । কিন্তু রঞ্জন ভীষণভাবে
অনুনয় বিনয় করে মুকুটধারীকে রাজি করায়, কিন্তু ফিরে যাবার অনুমতি পায়নি,
শুধুমাত্র ঘুরে আসার অনুমতি পেয়েছে । তার মধ্যেই সোনাকে এক ঝলক দেখে নিতে
বলেছে । ছোট একটা উপায় বুঝে রঞ্জন আসে ওর চেনা জায়গায় । এসেই ও ভীষণ চমকে
যায় । একি অবস্থা...! বাড়িতে ভীষণ অশান্তি । ওর বাবা ও শ্বশুর মশাইয়ের সাথে
তুমুল ঝগড়া হচ্ছে । আর ওর সোনা ওর ছবিটাকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বসে আছে ।
ইচ্ছা হচ্ছিল সোনাকে গিয়ে ও আদর করে । কিন্তু মুকুটধারী সে অনুমতি দেয়নি ।
এদিকে ঝগড়ার বিষয়বস্তটা শুনে রঞ্জন আরো আঘাত পেল । রঞ্জন একটা কোম্পানীতে
চাকরি করত । সেখানে একটি বিমা করিয়েছিল, এ ছাড়াও সে বেশ কয়েকটা বিমা করেছিল
। সে মারা যাবার পরই বিমা কোম্পানীর এজেন্টদের সাথে ওর বৌ রমা ও ওর
শ্বশুরমশাই যোগাযোগ করে সমস্ত কিছু দাবি পেশ করে । সব মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ
টাকার মত হবে । ও নমিনি করে গেছিল রমা ও সোনার নামে । এদিকে রঞ্জন ওর বাবার
কাছে অবজ্ঞার পাত্র । ও ভীষণ নিরীহ, কম কথার মানুষ, সেটা ওর বাবার পছন্দ
ছিল না, তার তুলনায় ওর বাবা ওর বদমেজাজী দাদাকে বেশি পছন্দ করত । রঞ্জনকে
বেশি পাত্তা দিত না । রঞ্জন সেটা জানত, কিন্তু এই ব্যাপারে সে কোন দিন
প্রতিবাদ করেনি । কিন্তু আজ সে দেখছে, সেই বাবা তার বৌ রমাকে জানাচ্ছে,
ছেলে যখন ছিল, দিব্যি ছিল... আজ সে যখন নেই, তার বৌ ও ছেলেরও কোন অস্তিত্ব
নেই তার কাছে । শুধু আছে ছেলের টাকা... সেটাই আসল । দয়া করে রমা বা সোনাকে
সমস্ত টাকার অর্ধেক দিতে পারে, তার বেশি নয় ... এই নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ
হয়ে চলেছে । রঞ্জন নির্বাক হয়ে দেখে যাচ্ছে আর ছেলের দিকে তাকিয়ে কেঁদে
যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না । হতাশ হয়ে সে ফিরে আসে মুকুটধারীর
দরবারে, আর এসেই তার পা ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে ... যে কান্না থামার নয় ।
... রঞ্জন কাঁদতেই থাকে ... কাঁদতেই থাকে ... হঠাৎ যেন সব কিছু আবার
অন্ধকার হয়ে গেল । কিছুক্ষণ পরেই কতজনের পরিচিত কন্ঠস্বর ওর কানে আসতে থাকে
। তার মধ্যে সবথেকে মিষ্টি আওয়াজটা ওর খুব আদরের, খুব কাছের... “বাবা...
ওঠ... উঠে পড়” ... ও চোখ খুলতেই দেখল সবাই ওকে ঘিরে রয়েছে... রমা জানাল,
ত্রিশ মিনিট ধরে ওকে সবাই ডাকছে, কিন্তু ওর মরা ঘুমে সবাই ভয় পেয়ে গেছিল,
রঞ্জন কাউকে কিছু বলল না, পাশে বসে থাকা সোনাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদতেই
থাকল ।
প্রকাশিত - জলফড়িং পত্রিকা, আত্মপ্রকাশ সংখ্যা, বৈশাখ, ১৪২২
No comments:
Post a Comment