Sunday, September 30, 2018

ছোট গল্প - অস্তিত্ব



রাজকুমার ঘোষ - 

“তোর যদি হিম্মত থাকে, তো একটা বাড়ি করে দেখা, আর পারলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা”... বাবার কাছে এই কথাটা শুনে রঞ্জন ভীষণ আঘাত পেয়েছে । গত তিন দিন ধরে ওর বাড়িতে অশান্তি চলছে । ও নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সংসারের ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামায় না । কিন্তু ওর বৌ রমার সাথে বাবার ঝগড়ার মাঝে ও এসে পড়েছে । ও কিন্তু বলেছিল, “তোমাদের এই অশান্তি ভালো লাগেনা, তার চেয়ে এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়া ভাল”... এরপর ঐ কথাটা ওর বাবা একবার নয়, বারবার বলেছিল... সেদিনের মত ওর খাওয়া আর হল না । ও ওর ছেলে সোনাকে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল । ৫ বছরের ছেলে সোনা তার বাবার কাছে ঘুমোবে, রঞ্জন ওকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, আর তাতেই ঘুমিয়ে পড়বে । ছেলে বাবা অন্ত প্রাণ । রঞ্জনও সোনাকে একেবারে কাছছাড়া করতে চায় না । সেদিন রঞ্জনের চোখে ঘুম আসে না । সোনাও আজ বাবাকে ছাড়াই নিজে ঘুমিয়ে পড়েছে । আজ রঞ্জন না খেয়েই ছিল, তার ওপর ওর শরীরটাও ক’দিন ধরে ভালো যাচ্ছিল না । বাবার ঐ কথাটা ভাবতে ভাবতে ও বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করল, ওর যেন মনে হল সমস্ত জগৎ হঠাৎ স্থির হয়ে গেছে । ওর কাছে সব কিছু অন্ধকার......, কিছুই ঠাহর করতে পারছে না । ওর পাশেই ছিল সোনা, সোনাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলো, কিন্তু খুঁজেই পেল না । এক গভীর কালো অন্ধকারের মধ্যে নিজেকে খুঁজে না পেয়ে চিৎকার করতে যাবে কি, চোখের সামনে কেমন যেন মায়ায় ঘেরা এক জগৎকে দেখতে পেল, সে একটু পা বাড়াতেই দেখতে পেল, এক ধোঁয়াশাময় দুনিয়ায় আরো কত মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কে যেন ওর হাতটা ধরে ঐ লাইনে ওকে দাঁড় করিয়ে দিল । লাইনের শুরুতে দেখতে পেল এক থুড়থুড়ে বুড়ো একটা বিরাট লম্বা খাতা নিয়ে কি যেন হিসাব করছে । আর ঠিক তার পেছনে শিংওলা মুকুটপড়ে এক ভদ্রলোক বসে আছে । সে এক একটা লোককে নিয়ে এসে কি জিজ্ঞাসা করছে আর অট্টহাস্যে চারপাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে । ওর কাছে সব কিছু কেমন অদ্ভুত মনে হতে লাগল । শেষমেশ লাইন ধরে ও এসে পৌছল মুকুটধারী লোকটির কাছে । পৌছেই ও লোকটিকে প্রশ্ন করল, “কি ব্যাপার, আমি এখানে কেন ? আমি ছেলের কাছে তো ছিলাম”... লোকটি বিকট হাসিতে জানাল, “তুই তোর সব মায়া ত্যাগ করে এখানে এসেছিস, বুঝতে পারছিস না ?... ওরে পাগল, মরে গেলে তো আমার কাছেই আসতে হয়”... এই কথা শুনে রঞ্জনের মাথাটা ঘুরে গেল । সে করুন আর্তি জানায়, তাকে ছাড়া সোনা কি ভাবে থাকবে, আর সেইবা কি ভাবে থাকবে , এই বলে সে প্রচন্ড কাঁদতে লাগল । মুকুটধারী লোকটি ওকে বোঝালো, নিয়ম অনুযায়ী রঞ্জন এখানে এসেছে, সুতরাং সোনাকে ছাড়া এখানেই থাকতে হবে । কিন্তু রঞ্জন ভীষণভাবে অনুনয় বিনয় করে মুকুটধারীকে রাজি করায়, কিন্তু ফিরে যাবার অনুমতি পায়নি, শুধুমাত্র ঘুরে আসার অনুমতি পেয়েছে । তার মধ্যেই সোনাকে এক ঝলক দেখে নিতে বলেছে । ছোট একটা উপায় বুঝে রঞ্জন আসে ওর চেনা জায়গায় । এসেই ও ভীষণ চমকে যায় । একি অবস্থা...! বাড়িতে ভীষণ অশান্তি । ওর বাবা ও শ্বশুর মশাইয়ের সাথে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে । আর ওর সোনা ওর ছবিটাকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে বসে আছে । ইচ্ছা হচ্ছিল সোনাকে গিয়ে ও আদর করে । কিন্তু মুকুটধারী সে অনুমতি দেয়নি । এদিকে ঝগড়ার বিষয়বস্তটা শুনে রঞ্জন আরো আঘাত পেল । রঞ্জন একটা কোম্পানীতে চাকরি করত । সেখানে একটি বিমা করিয়েছিল, এ ছাড়াও সে বেশ কয়েকটা বিমা করেছিল । সে মারা যাবার পরই বিমা কোম্পানীর এজেন্টদের সাথে ওর বৌ রমা ও ওর শ্বশুরমশাই যোগাযোগ করে সমস্ত কিছু দাবি পেশ করে । সব মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার মত হবে । ও নমিনি করে গেছিল রমা ও সোনার নামে । এদিকে রঞ্জন ওর বাবার কাছে অবজ্ঞার পাত্র । ও ভীষণ নিরীহ, কম কথার মানুষ, সেটা ওর বাবার পছন্দ ছিল না, তার তুলনায় ওর বাবা ওর বদমেজাজী দাদাকে বেশি পছন্দ করত । রঞ্জনকে বেশি পাত্তা দিত না । রঞ্জন সেটা জানত, কিন্তু এই ব্যাপারে সে কোন দিন প্রতিবাদ করেনি । কিন্তু আজ সে দেখছে, সেই বাবা তার বৌ রমাকে জানাচ্ছে, ছেলে যখন ছিল, দিব্যি ছিল... আজ সে যখন নেই, তার বৌ ও ছেলেরও কোন অস্তিত্ব নেই তার কাছে । শুধু আছে ছেলের টাকা... সেটাই আসল । দয়া করে রমা বা সোনাকে সমস্ত টাকার অর্ধেক দিতে পারে, তার বেশি নয় ... এই নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ হয়ে চলেছে । রঞ্জন নির্বাক হয়ে দেখে যাচ্ছে আর ছেলের দিকে তাকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না । হতাশ হয়ে সে ফিরে আসে মুকুটধারীর দরবারে, আর এসেই তার পা ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে ... যে কান্না থামার নয় । ... রঞ্জন কাঁদতেই থাকে ... কাঁদতেই থাকে ... হঠাৎ যেন সব কিছু আবার অন্ধকার হয়ে গেল । কিছুক্ষণ পরেই কতজনের পরিচিত কন্ঠস্বর ওর কানে আসতে থাকে । তার মধ্যে সবথেকে মিষ্টি আওয়াজটা ওর খুব আদরের, খুব কাছের... “বাবা... ওঠ... উঠে পড়” ... ও চোখ খুলতেই দেখল সবাই ওকে ঘিরে রয়েছে... রমা জানাল, ত্রিশ মিনিট ধরে ওকে সবাই ডাকছে, কিন্তু ওর মরা ঘুমে সবাই ভয় পেয়ে গেছিল, রঞ্জন কাউকে কিছু বলল না, পাশে বসে থাকা সোনাকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদতেই থাকল ।
প্রকাশিত - জলফড়িং পত্রিকা, আত্মপ্রকাশ সংখ্যা, বৈশাখ, ১৪২২ 

Saturday, September 29, 2018

কবিতা - নরহরি কথা


রাজকুমার ঘোষ -
বাউন পাড়ার নরহরি, পৈত্রিকসূত্রে কোটিপতি,     
বাতেলার বুলি দিয়ে সংগঠনের সভাপতি...   
নিজেকে ভাবে সর্ব্বজ্ঞানী, আঁতলামিতে শ্রেষ্ঠ       
সুযোগ পেলেই হয়ে যায় কলিযুগের কেষ্ট    
সখ তার বলিহারি, মামনিরা বলবে সুরে,
নরহরি!কাছে এস, থাকো কেন এত দূরে    
নরহরি ভাবে বটে বাজারদর তার তুঙ্গে!      
মিষ্টি হেসে দাঁত দেখালেই, কন্যে আসবে সঙ্গে     
স্টাইল নাকি ফাটাফাটি, সাথে যখন বাইক,     
ফেসবুকে পোস্টটি দিলে, মেয়েরা দেবে লাইক      
মেয়ে ফাঁসানোর ছলাকলা অনেক আছে জানা,   
প্রেমের পদ্য শুনিয়ে দিলে মেলবে নাকি ডানা...         
গানের কথায় ভাবে তার কন্ঠে আছে জাদু,     
মেয়েগুলো ফাঁসবে তাতে, চাইবে আরও মধু   
ফেসবুকেতে আছে তার অনেক প্রোফাইল,       
বিশ্বব্যাপী মামনিদের দেখায় শুধু স্টাইল     
ইনবক্সে হরেক রকম রস-কথার নেশা,  
মামনিরা সাড়া দিলেই মিটবে সব আশা           
তার দোষ দেখলে কেউ দেয় হুঁশিয়ারী,      
“মিথ্যার জালে জড়িয়ে দেব”আমি যে নরহরি 

Friday, September 28, 2018

রম্যরচনা - নেলোর বিভ্রান্তি

রাজকুমার ঘোষ -
 
        গুচ্ছের বিভ্রান্তি নিয়ে নেলোর মত একটা মানুষ এই জগতে থাকতে পারে, তা ওকে দেখে বোঝা যায় না  রোগা-পটকা চেহারার নেলো মনেপ্রাণে  ছুকছুক বাই গ্রস্ত পাবলিক, সেটা কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না বা কাউকে বুঝতে দেয় না তার যে কিসের দুঃখ, কিসের হতাশা আবার তার যে আনন্দ কখন আসে সে নিজেও জানেনা । তার নাম নিলমণী পাত্র, কিন্তু বন্ধুদের সৌজন্যে সেটা নেলোতে এসে দাঁড়িয়েছে ।   
 
        এই নেলো বিভ্রান্ত লগ্নেই জন্মেছে মনে হয়, তার জীবনের প্রথম চুলকানি, দুঃখিত বিভ্রান্তি …………  সবে সে স্কুল গন্ডি পার করে কলেজে এন্ট্রি নিয়েছে,  সেখানে গিয়েই একজন মেয়েকে দেখে নেলোর চুলকানি শুরু  যেই দেখা, ব্যাস গড় গড় করে একটা লাভ লেটার লিখে প্রোপোজের জন্য বাস স্ট্যান্ডের দিকে গেছিল, মেয়েটি বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল  মেয়েটির কাছে গিয়ে নেলো নাচতে শুরু করে দিল দেখা গেলো, পকেট থেকে চিঠি বার করার বদলে বেরিয়ে এল  সালিকল মলম !  বিভ্রান্তির সেই শুরু,   মেয়েটি ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল …… পরে জানা গেল, পানুর চুলকানি শুধু মনের নয় অন্য চুলকানিও আছে যার জন্য মলমের দরকার হয় টেনশনে নাকি নেলোর দ্বিতীয়  চুলকানিটা প্রকট হয়ে যায় এবং তা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়   সেদিনও তাই হয়েছিল  টেনশনে চুলকানি শুরু আর চিঠির বদলে মলম আর সেই সাথে নাচানাচি আহারে নেলো, জ্বালার চেয়ে যন্ত্রনা বেশি, সেই বিভ্রান্তির শুরু আর কি !         
        এইরকম বিভ্রান্তির কেস আরো আছে   ইতিহাস কোচিং- নেলোর সাথে এক সুন্দরীর আলাপ হয়েছিল, নেলো তো অস্থির না চাইলেও সে বিভিন্ন ভাবে মেয়েটিকে সাহায্য করতো , ফুচকা খাওয়াতো, সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেত অথচ নেলো নিজের মনের কথা কিছুতেই জানাতে পারতো না, ভয় একটাই, যদি চড় খেয়ে পিরিত চটকে  যায় কিন্তু নেলো স্থির করে সে প্রোপোজ করেই ছাড়বে  একদিন  নেলো একটা চিঠি নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে, সেদিনই মেয়েটি তাকে ২টো সিনেমার টিকিট কাটতে বলে, মেঘ না চাইতেই জল…! ভীষণ বিগলিত হয়ে সে যথাসময়ে টিকিট নিয়ে হাজির মেয়েটি ওর বিভ্রান্তি বাড়িয়ে টিকিট ২টো হাতে নিয়েথ্যাঙ্ক য়্যুজানিয়ে চলে গেল পর দিন  জানতে পারলো মেয়েটি তার বিশেষ লোকের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল নেলো কার্যতঃ খুবই হতাশ এরপরও নেলো অনেক মেয়েকে তার হৃদয়ে আশ্র্য় দেবার জন্য পিড়াপিড়ি করেছিল, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি কেউ তাকে ভাই, কেউ দাদা বা কেউ বন্ধু বানিয়ে ফেলছে কিন্তু প্রেমিক হিসাবে কারোর মনে ধরছে না   মনের মধ্যে সেই বিভ্রান্তি নিয়েই নেলো  তার পুরো কলেজ লাইফটা কাটিয়ে দিল           
        নেলো একটা ভালো চাকরী পায় বিয়ে করার জন্য মেয়ে দেখতে থাকে কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই, কিছুতেই মেয়েরা পছন্দ করতে চায় না বিভ্রান্তি বাড়তেই থাকে তার সাথে চুলকানিও থামেনি, বরং মিড্নাইট  ইংলিশ মুভি দেখে আরো বেড়ে গেছিল এইভাবে চলতে চলতে একদিন নেলোর চোখ চলে গেল পাড়ার বিখ্যাত হট মেয়ে টুম্পার দিকে যার হাজারখানেক বয়ফ্রেন্ড   টুম্পা নেলোর থেকে বয়ষে অনেকটাই ছোট সে যাই হোক, টুম্পাকে নেলোর সেই মিড্নাইট ইংলিশ মুভির হট নায়িকা মনে হতে লাগল যথারীতি বিয়ের প্রস্তাব টুম্পা টুম্পার পরিবারও তাতে সায় দিল বেশ ঘটা করে নেলো-টুম্পার বিয়ে হয়ে গেল বিয়ের এক বছর পর একটা ফুটফুটে মেয়ে হল   চুলকানিটা কমলেও কিন্তু নেলোর বিভ্রান্তিটা থেকেই গেল তবে এবারের কেশটা অন্যরকম নেলো ভাবতে লাগল সদ্যোজাত মেয়েটি আদৌ তার তো

প্রকাশিত - সপ্তাশ্ব পত্রিকা, দ্বিতীয় বর্ষ, বর্ষাবরণ, ২০১৬