~ রাজকুমার ঘোষ
শহরের কোলাহলে জটিল জীবন কয়েক মণ ভার নিয়ে মানুষের জীবন দিশাহারা করে দিচ্ছে দিনের পর দিন। সেখান থেকে বেরোতে পারা সম্ভব তো নয়ই, বরং বরং দিন দিন এই ভার জেঁকে বসেছে। তবুও ইচ্ছা হয় সেই ভার থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে। সেই কারণেই বাঙালি মন চায় কোলাহল মুক্ত জীবন। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। মাঝেই মাঝেই পাহাড়ের দিকে মন টানে। আর পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার মজাই আলাদা রকমের, সেটা যদি আবার সিকিমের মত পাহাড়ি রাজ্য হয়। ভাবা যায় গোটা রাজ্যটাই পাহাড়ের মধ্যে অবস্থিত, যার রাজধানী গ্যাংটক হল তার মধ্যমণী । বেশ কয়েক বছর আগে আমরা দার্জিলিং-এ যাব বলে বেড়িয়েছিলাম, কিন্তু রাজনেতিক অস্থিরতার দরূণ আমরা সিকিমে চলে এসেছিলাম। তখন আমরা ছাঙ্গু, বাবাধাম, ইয়ুমথাংগ পর্যন্ত্যই আটকে গিয়েছিলাম, কিন্তু লোক মুখে শোনা জিরো পয়েন্টকে না দেখেই ফিরে আসতে হয়েছিলো। কাছে এসেও দেখতে না পেয়ে ভীষণ আক্ষেপ হয়েছিলো । মনের সেই ইচ্ছাটা ভাগ্যিস ধরে রেখেছিলাম । তাই গতবছর পূজোর পর টার্গেট করেই রেখেছিলাম যে আবার আমরা গ্যাংটক যাব, মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই জিরো পয়েন্ট ।
ইচ্ছা অনুযায়ী লক্ষী পুজোর ঠিক পরের দিনই আমরা দল বেধেঁ গ্যাংটক থুরি জিরো পয়েন্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম । প্রায় ৮ জন নিয়ে আমাদের দল বেশ ভারী ছিলো । স্বাভাবিক ভাবেই আমরা সবাই খোশমেজাজে। আমার হিরো মানে আমার ছেলে ঋষভ তো বেজায় খুশি। তার কাছে এই ঘুরতে যাওয়া এক বিরাট অনুভব, সে আমার কাছে সিকিম তথা গ্যাংটক এমনকি জিরো পয়েন্ট নিয়েও জেনে নিয়েছে ।
শিয়ালদাহ থেকে রাতের কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরে আমরা সবাই গ্যাংটক পৌছে গেলাম পরের দিন সকালে, তারপর সেখান থেকে ট্রাভেলের গাড়িতে চেপে পাহাড়ী রাস্তার অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আমরা বিকালে গ্যাংটক পৌঁছে গেলাম। সেদিনের মত বিশ্রাম নিয়ে তার পরের দিন থেকেই আমাদের চোখ থাকার স্বার্থকতাটা বুঝতে পারলাম। পরের দিন ছাঙ্গু ও বাবাধাম, তার পরের দিন পশ্চিম সিকিমের সান্ড্রাপ্সি, সাই বাবার মন্দির ও চারধাম দেখে আমরা সবাই অভিভূত। আমাদের খুব ইচ্ছা ছিলো যে ছাঙ্গু ও বাবাধামের বরফ পড়া দেখবো, কিন্তু বেশ হতাশ হয়েছিলাম। সেভাবে কিছুই দেখতে পেলাম না। যেদিন গিয়েছিলাম ঠিক তার পরের দিনই নাকি বরফ পড়েছে। হতাশ যেন আরো বেড়ে গেলো। বৃষ্টি পড়ায় নাকি ওখানে বরফ পড়েছে। তা আমরা গ্যাংটকের যে হোটেলে ছিলাম, সেখানকার ম্যানেজার বললো জিরো পয়েন্টে বরফ নাকি পাবোই, শুনে বেশ আনন্দ পেলাম। সেইভাবে ম্যানেজারই ব্যবস্থা করে দিলো। মাথা পিছু ২৫০০ টাকা প্যাকেজে আমাদের উত্তর সিকিমে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। সে দায়িত্ব নিয়ে আমাদের তার পরের দিন বেলা ১১টায় গাড়িতে তুলে দিলো। গ্যাংটক থেকে আমরা উত্তর সিকিমের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। এরপর আমরা যত এগোচ্ছি উত্তর সিকিমের দিকে ততই মনে শিহরণ জাগছিল, বিশেষ করে ঋষভের। হয়তো এর আগে আমরা এই রাস্তা দিয়ে ইয়ুংথাংগ গিয়েছি, কিন্তু কলকাতার কোলাহল মিশ্রিত মন এবং অবশ্যই দূষণ যুক্ত দৃষ্টি বারে বারে এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হবে এটাই তো স্বাভাবিক। গোটা ব্যাপারটাই যেন কোলাহল মুক্ত। শুধু চোখ আর মনের অপার শান্তি। দেখতে দেখতে আমরা চলে এলাম মঙ্গনে। তার আগে অবশ্য আমরা ড্রাইভারের ঠিক করা একটি হোটেলে লাঞ্চটা সেড়ে ফেলেছিলাম। এরপর আমরা যাবার পথে ‘সেভেন সিস্টার’ জলপ্রপাত দেখলাম। ভয়ংকর সুন্দর এই জলপ্রপাতটি দেখে সকলে মোহিত হয়ে গেলাম। এই ফলসের কাছে গিয়ে আমরা যে যার মতো সুপার পোস দিয়ে ছবি তুলে নিলাম, আমিও এই প্রাকৃতিক দৃশ্যকে উপভোগ করে ছেলে ও ওয়াইফকে নিয়ে ক্যামেরা বন্দী করে নিলাম ।
বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যে হয়ে এলো অথচ আমাদের গন্তব্য লাচুং তখনও অনেক দূরে । এর আগে যখন এসেছিলাম আমরা প্রায় সন্ধ্যের মুখে লাচুং এ পৌছে গিয়েছিলাম । কিন্তু এবার রাস্তা ভীষন খারাপ থাকায় এত সময় লাগলো। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে জানালো লাচুং পৌছতে রাত ৮টা বেজে যাবে। উত্তর সিকিমে চুংথাং নামে একটি টাউন ছিলো। গ্যাংটক থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে উত্তর সিকিমের একটি জনপ্রিয় টাউন, যেখানে ইন্ডিয়াম আর্মির বেস ক্যাম্প আছে, আর বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আছে। সন্ধ্যে হওয়ার দরুন আমরা এই চুংথাং টাউন টিকে সেইভাবে দেখতে পেলাম না। উত্তর সিকিমের আরেকটি জনপ্রিয় টাউন মঙ্গনও খুব সুন্দর। এই পাহাড়ি টাউনটির চারিদিকে বিশাল জনবসতি ও দোকানপাটে ঘেরা। গতবারে এসে ছোট অথচ জনপ্রিয় এই টাউনটি দেখে দারুন আনন্দ পেয়েছিলাম। ভাবতে পারেনি যে এই দূর্গম পাহাড়ের মাঝে এত সুন্দর একটি টাউন থাকতে পারে। কিন্তু এবারে গিয়ে এই মঙ্গন-এর রুপ দেখে একেবারে মন খারাপ হয়ে গেল। ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ এ এক বিদ্ধস্ত ভুমিকম্পে মঙ্গন পুরোপুরি ভাবে এলোমেলো। এখানে রাস্তাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। সিকিম সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে উত্তর সিকিমকে আরো সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলার। এবং তাদের চেষ্টাও অনস্বীকার্য। দেখলাম তারা আবার মঙ্গনকে সাজিয়ে তুলছে আগের মতই। প্রায় ৬.৯ ম্যাগ্নিচুডে জোরালো ভুমিকম্পে মঙ্গন সহ উত্তর সিকিমের অন্যান্য জায়গায় যে প্রভাব পড়েছে সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমরা প্রায় ৭টার সময় চুংথাং এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ই টের পাচ্ছিলাম যে এই পথ কত দূর্গম ! যাই হোক ঠিক রাত ৮ টার খানিক আগে ড্রাইভার লাচুংয়ে আমাদের একটি হোটেলের সামনে গাড়ি নিয়ে চলে এলো। বুঝে গেলাম আজকের রাতে আমাদের এইখানেই থাকতে হবে। রাত ১০ টা নাগাদ আমাদের ডিম-ভাত-সব্জি দিয়ে ডিনার খাওয়াতে বুঝে গেলাম গ্যাংটকের হোটেলের ম্যানেজার আমাদের কতখানি চুনা দিয়েছে । হোটেলের অবস্থা মোটামুটি মন্দের ভালো। ড্রাইভার সকলকে বলে গেলো ভোর ৬ টার সময় উঠতে হবে, সে আমাদের ইয়ুংথাম এ নিয়ে যাবে, তারপর মর্জি হলে জিরো পয়েন্ট । আসলে গ্যাংটকের ঐ হতচ্ছাড়া ম্যানেজারের প্যাকেজ এ জিরো পয়েন্ট ছিলো না ।
ভোর ৬টার সময় আমরা ঘুম থেকে উঠে যে যার মত করে প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। ঋষভও দেখলাম বেশ উৎসাহ নিয়ে তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা ইয়ুংথাম চলে এলাম। সেখানে গতবারে এসে আমরা দারুন মজা করেছিলাম, তাই এবারে এসে অতটা আগ্রহ দেখালাম না। আমাদের চোখ যে জিরো পয়েন্ট। ড্রাইভারকে বললাম আমরা যত তাড়াতাড়ি পারি জিরো পয়েন্ট এ যেতে চাই। ওর সাথে মাথা পিছু ২০০০ টাকার রফা করে আমরা এগিয়ে চললাম জিরো পয়েন্টের দিকে। আমাদের চোখ সার্থক হবেই এই মনোভাবে একরাশ আনন্দ ও প্রত্যাশা নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম কাঙ্খিত জিরো পয়েন্টের দিকে। যেতে যেতে কত সুন্দর দৃশ্য আমাদের নজরে এলো যে অভিভূত শব্দও বুঝি তাতে কম হয়। গাড়ি থেকেই আমি অনেক দৃশ্য আমার মোবাইলের ক্যামেরায় নিয়ে নিলাম। আরো ৪০ মিনিট পর আমরা পৌছে গেলাম জিরো পয়েন্ট এ। গাড়ি থেকে নেমেই আমি প্রনাম জানালাম এই অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে। যে দিকে তাকাই শুধু সাদা চাদরে মোড়া বরফের সমাহার। ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করবো, কোথা থেকে শুরু করবো এই অনন্য সুন্দর শোভাকে নিজের মত করে উপভোগ করার, বেশ দ্বন্ধে পড়ে গেলাম। যেদিকে চাই, সেদিক টাকেই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। অনেক ছবি তুললাম মনের মত করে, তবুও যেন কম হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ১০০র বেশি ছবি তুললাম, সেটাও যেন খুব নগণ্য। আমার ছেলে ঋষভ বরফ নিয়ে খেলা করতে লাগলো, ওর মাও ওর সাথে যোগ দিলো। ওরা ওদের মত করে এই সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করতে লাগল। তার ওপর সূর্যমামা আজ বড়ই প্রসন্ন, তার ছটা উঁচু হয়ে থাকা বরফে আবৃত শৃঙ্গ গুলোকে আর আলোকিত করে তুলেছিলো। সেই আলোর ছটায় আমরা আরও উদ্ভাসিত। আমি সেই মনোরম শোভাকে ক্যামেরা বন্দী করতে ভুল করলাম না।
আমরা সবাই বিভিন্ন রকম পোস দিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। আমি নিজেকে হিরো ভেবে পোস দিলাম আর আমার স্ত্রীকে বললাম ফটো তুলতে। তার ওপর বেশ কনকনে ঠান্ডা, আমি শুধু সোয়েটার পড়ে শাহরুখ খান স্টাইলে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। প্রায় দু'ঘন্টা আমরা সবাই বেশ মজা করলাম। ২ ঘণ্টা কাটিয়ে আমাদের মনে হলো যে সমস্ত পয়সা উসুল, আমাদের এখানে আসা সার্থক । গ্যাংটকের হোটেলের সেই বদ ম্যানেজারকে আর গালাগাল দিতে ইচ্ছা করলো না। কারণ আমাদের চোখে শুধু জিরো পয়েন্টের বিষ্ময়, শুধু তার শোভাই বিরাজ করছে চোখে ও মনে। ফেরার পথে আরো অনেক ছবি তুলে আমরা লাচুং-এ ফিরে এলাম। আবার সেই ডিম-ভাত-সব্জি দিয়ে লাঞ্চ করে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে ফিরে যাওয়ার পথ ধরলাম। ঐ পথ ধরে যখন ফিরছিলাম, ভয়ানক দূর্গম রাস্তা দেখে আমরা হতবাক। অথচ ড্রাইভার গতকাল রাতেই ঐ রাস্তা দিয়েই নিয়ে এসেছে। মনে মনে ড্রাইভারকে বাহবা দিলাম। চুংথাং টাউন দিয়ে যাবার সময় একটা মর্মান্তিক ঘটনা আমাদের সকলকে বেশ ব্যাথিত করে তুলল। জানতে পারলাম একটা মিলিটারি গাড়ি নাকি খাদে পড়ে গেছে। ঐ গাড়িতে ইন্ডিয়ান আর্মির প্রায় ১৬ জন জওয়ান ছিলো। ড্রাইভারই আশেপাশের লোকজনের কাছ থেকে খবর নিয়ে আমাদেরকে জানালো। মঙ্গন হয়ে ফেরার সময় আবার ‘সেভেন সিস্টার’ ফলস দেখে ফেললাম। বিকাল হয়ে সন্ধ্যে চলে এলো। আমাদের গাড়ি গ্যাংটকের দিকে ছুটে চলেছে। গাড়িতে আমাদের সবাই ঘুমে কাতর। আমার চোখ দুটো একটু বুজতে চাইলো, কিন্তু জিরো পয়েন্টের সমস্ত সোন্দর্য্য সেটা হতে দিলো না। ক্লান্ত চোখেও আমি নিখাদ কোলাহল মুক্ত জিরো পয়েন্টের কথা ভেবে আমার মোবাইলের নোটপ্যাডে একটু কবি হওয়ার চেষ্টা করলাম ………
বরফের চাদর
কি অপূর্ব শোভা, তার কি মহিমা !!
সার্থক, আজ আমি করি তার বন্দনা …
বরফের চাদরে মোড়া, হে অপরূপা
জিরো পয়েন্ট, সৃষ্টির অনন্য এক শিরোপা !
No comments:
Post a Comment