ফেলু মিত্তিরের কেমন একটা যেন মনে হলো। বেশ একটা ঘুমের ঘোরে ছিলেন। হঠাৎ করেই ভেঙে গেলো। কিন্তু চোখের সামনে এতো মেঘ, মানে এই মেঘ যে সে মেঘ নয়। সোনার মেঘ। তাঁর সারা শরীর জুড়ে মেঘের কেমন একটা মায়া মায়া স্পর্শ। বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি মনে হচ্ছে তাঁর। আশে পাশে কেউ নজরে এলো না। ফেলুদা এগিয়ে চললেন। কোনো দিক নির্দেশ নেই, মনে হচ্ছে তাঁর পা তাকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার মন তাকে বাধাও দিচ্ছে না। সবই কেমন যেন একটা ভালো লাগার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই কি একটা কোলাহলের শব্দ শুনতে পেলেন ফেলুদা। খুব খুব চেনা চেনা কন্ঠস্বর। দীর্ঘদিন পর আর একটি পরিচিত গলা ফেলুদার নাম করে ডাকছে।
"ও মশাই, ও মশাই ... আরে এদিকে আসুন, এদিকে..." ফেলুদা এই গলার আওয়াজে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে গেলো। এতো তাঁরই সফর সঙ্গী তথা রহস্যভেদের সঙ্গী লালমোহনবাবু। অনেকদিন পর গলাটা শুনে কি ভালো লাগছে ফেলুদার। ফেলুদা গলাটা শুনেই চলে এলেন সেখানে - তারপরজটায়ুঃ হুররে, স্বর্গরাজ্য অপরাধমুক্ত করার আসল মানুষ এসে গেছেন৷
ফেলুদাঃ কি বলছেন লালমোহনবাবু ? এখানেও অপরাধ ! বলেন কি...
জটায়ুঃ হাইলি সাসপিসিয়াস (মগনলালের উদ্দেশ্যে)... ব্যাপারটা ভালো মনে হচ্ছে না ।
ফেলুদাঃ কেন কি হলো আবার ?
কিছুদূরে মগনলাল বসে ছিলেন। কিছুটা আন্দাজ করলেন -
মগনলালঃ আর বলেন না ফেলু মিত্তির৷ বেনারসে সেই যে ঘটনা হয়েছিল, সেই ট্রমা থেকে এখনো বেরোতে পারেননি আঙ্কেল। যাই হোক, ওয়েলকাম, ফেলু মিত্তির। মর্ত্যে আমার অনেক সাগরেদ ছিল, আপনি তাই শত্রু ছিলেন৷ কিন্তু এখানে আপনি আমার বন্ধু আছেন। আর এখানে ক্রাইম করার জায়গা নেই। ইন্দ্রদেব একাই সেই দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন। আর এখানে কেউ দোস্ত হতে চাইছে না আমার সাথে। একা একা হয়ে যাচ্ছি। আশা করি, এবার থেকে আর বোর হবোনা সিওর।
জটায়ুঃ ওর একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। দেখেছিলেন তো, আমার কি অবস্থা করেছিল। ওকে দেখলেই আমার কেমন মাথা ভন ভন করে ঘুরতে থাকে।
মগনলালঃ ছাড়েন ছাড়েন ওর কথা। আসুন এখানে একটু দাবার চাল হয়ে যাক। ও আঙ্কেল ভিতুর ডিম আছে। কতবার বললাম, আসুন একটু দাবার চাল শিখিয়ে দিই। কে শোনে কার কথা। আমাকে এখনও ভিলেন ভাবে।
জটায়ুঃ ভিলেন শুধু, ভেরি সাসপিসিয়াস। চোখ খানা দেখছেন, ফেলুবাবু। কেমন লাল আর ভয়ংকর।
ফেলুদাঃ আরে আমি আছি তো লালমোহনবাবু।
জটায়ুঃ একদমই তাই। আপনি এসে পড়েছেন আমার আর চিন্তা নেই। এতদিন যে কিভাবে ছিলাম আমি। এখানে সবকিছু শান্ত, নতুন কোনো প্লটও আসছে না। ভাবলাম 'স্বর্গরাজ্যে হানাদার' নামে একটা দুর্দান্ত ক্রাইম থ্রিলার লিখব। প্রখর রুদ্র তার শক্তি আর বুদ্ধির জোরে সব কিছু সমাধান করে দেবে। কিন্তু এখানে তো সবই সুন্দর। আপনিও নেই। সবাই কি ভালো। এই মগনলাল এসেই আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
মগনলালঃ হা হা হা হা ... ডরপুক আঙ্কেল। ভাগো ইয়াসে। আসুন ফেলুবাবু, হয়ে যাক তবে, একটু দাবা খেলি।
ফেলুদাঃ নিশ্চয়ই৷ তবে তার আগে আমার আসল তিন বন্ধুর সাথে একটু দেখা করি। আমি ওদের শ্যাম যে। কতদিন যে বসন্ত বিলাপের সামনে আড্ডা দিইনি। হ্যাঁ ওদের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। আমার তিন প্রিয় বন্ধু - নাটা করে গুপ্ত (ফেলুদা ডেকে নিলো, সাথে আরও দুজনকে)। প্যাংলা চেহারার সিধু আর লালু।
গুপ্তঃ এইতো আমাদের পেছনে তুইও এসেছিস শ্যাম। হুররে। আজ আমরা মই নিয়ে তৈরী হচ্ছিলাম, এখানে অপ্সরাদের গেস্ট হাউসে হানা দেবো। তোকেও পেয়ে গেলাম। অপ্সরাদের নাচের বারোটা বাজাবো৷ জানিস, আমাদের হ্যাটা করেছে। আমাকে আর সিধুকে বলেছে কিনা 'লরেল হার্ডি' ।
সিধুঃ দেড় বছর হলো আমি এখানে এসেছি শ্যাম। এখানে থেকে কেমন দেখতে হয়েছে রে আমাকে।
লালুঃ আহা! উত্তমকুমারের মত, একটা অপ্সরাও যদি তোর এই প্যাকাটির মত চেহারার দিকে তাকাতো। 😆😆
সিধুঃ ঠিক হবে না বলছি লালু। তোকে ধরে কেটে ফেলবো। 😡😡 জানিস শ্যাম, আমি এখানে একটা অপ্সরাকে পটিয়েও ফেলেছিলাম, মাঝখান থেকে এই লালু সব গুবলেট করে দিলো।
ফেলুদা চলে এলেন শ্যামের আদলে ...
শ্যামঃ আচ্ছা ঠিক আছে। ঠিক আছে। তোরা সেই এক রয়ে গেলি। চেঞ্জ আর হলি না।
লালুঃ তোর সাথে এরা কে শ্যাম? সামনে এই টাকলাটা আর ওখানে বাবুর মতো বসে থাকা মালটা?
শ্যামঃ চুপ কর। ইনি (জটায়ুকে দেখিয়ে) লালমোহনবাবু।
জটায়ুঃ (ফেলুদাকে থামিয়ে, গদ্গদ হয়ে) আমি হলাম জটায়ু, লালমোহন গাঙ্গুলি। আমার অনেকগুলো বিখ্যাত রহস্য উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। প্রখর রুদ্রের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই।
গুপ্তঃ কি ক্ষুদ্র?
জটায়ুঃ (ঘাবড়ে গিয়ে) কি বলছেন? আপনি প্রখর রুদ্রের নাম শোনেননি?
গুপ্তঃ দূর মশাই, শুনেছি শুনেছি। আমিও তো লিখেছিলাম প্রখর রুদ্রকে নিয়ে।
লালুঃ উপস্থিত। আমিও আছি। আমিও লিখেছি প্রখর রুদ্রকে নিয়ে। আর লিখতে লিখতে আমরা টপকে গেছি, আর এখানে চলে এসেছি।
জটায়ুঃ কিরকম কথা হলো, ফেলুবাবু এরা কি বলছে?
মগনলালঃ কি আঙ্কেল, আবার ভয় পেলেন মনে হচ্ছে। আরে ওই প্যাংলা বাদে বাকি দুজন মর্ত্যে আপনার ভূমিকায় ছিলো কিছুদিন। কি ঠিক বললাম তো ফেলু মিত্তির।
শ্যামরুপি ফেলুদাঃ ঠিকই বলেছেন মগনলালজী। লালমোহনবাবু একটু ব্যাপারটা পরিস্কার করে দিই। সে এক দুঃখের কথা। একে একে তো আপনি, মগনলাল তারপর আমাদের গ্রেট ডিরেক্টর শ্রী সত্যজিত রায় চলে এলেন এখানে। ওখানে তো ফাঁকা। অথচ পাবলিক ডিমান্ড। রায়বাবুর ফেলুদাকে সবাই দেখতে চায়। সাথে জটায়ু ও তোপসেকেও। ওনারই ছেলে সন্দীপ রায় পাবলিকের ডিমান্ড বুঝে ব্যবস্থা করলেন ফেলুদার সিরিজ। তবে তা বোকাবাস্কের জন্য। প্রতিভাধর অভিনেতা বেনুকে ফেলু মিত্তির সাজালো। আর জটায়ু করলো আমাদের গুপ্তকে। কিন্তু গুপ্ত হঠাৎ করে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে এলো এখানে। তারপর লালু এলো ওর জায়গায়, সেও চলে এলো এই অচেনা রাজ্যে।
মগনলালঃ হুম, আমি বসে বসে কি আর করবো। সব খোঁজ রাখি। মস্তি-ফস্তি আমার সহ্য হয় না। তাই এখানকার নিউজ পেপার আর চ্যানেল গুলো ফলো করি। সব খবর রাখি। তবে আমার কিন্তু আঙ্কেলকে বেশি পছন্দ। 😆😆 😆😆
জটায়ুঃ এই মরেছে রে। হাইলি সাসপিসিয়াস। (বলেই ফেলুদাকে জড়িয়ে ধরলো )
ফেলুদাঃ আরে ভয় নেই। কি করছেন।
(তিনমূর্তি জটায়ুর কান্ড দেখে হাসতে লাগলো ভীষণ)
ফেলুদাঃ তবে হ্যাঁ, বেনু কিন্তু দারুণ ভাবে মানিয়ে গেছে ফেলুদার সাথে। পাবলিকও ভালো ভাবে মেনে নিয়েছে। বেশ কটা ফেলুদা সিরিজ নিয়ে সন্দীপ সিনেমাও করে ফেললো। সব কটাই রেকর্ড করেছে। পাবলিকের কাছে দারুণভাবে সাড়া ফেলেছে। আর জটায়ুও কিন্তু দারুণ কামব্যাক করেছে 'বিভু'র মাধ্যমে।
জটায়ুঃ ও মাস্টার বিভু। সেই শিশুর ভূমিকায় অভিনয় করতো বিভিন্ন ঠাকুরের সিনেমায়।
ফেলুদাঃ একদম ঠিক লালমোহনবাবু। কিন্তু সেই বিভুও আর রইলো না। জটায়ু চরিত্র যেন একটা আপনার কথা অনুযায়ী "হাইলি সাসপিসিয়াস" হয়ে গেলো। সবাই চলে এসেছে এখানে। এরপর আর কোনো জটায়ু হয়নি। তবে আবির বলে একটা ছেলে ফেলুদা হয়েছে সেখানে জটায়ুর ভূমিকা নেই।
মগনলালঃ তাহলে স্বর্গরাজ্যে এখন আঙ্কেলদের ভিড় কি বলেন আঙ্কেল। (বলেই হো হো হো করে হাসতে লাগলেন)
জটায়ুঃ ও মশাই, ও যে হাসলেই আমি কেমন বিপদের গন্ধ পাই (ফেলুদাকে দেখে)
লালুঃ এটা কে রে? তখন থেকেই শুধু কেঁপে যায়।
সিধুঃ ও আঙ্কেল। আমাকে দেখেও আপনি চমকাচ্ছেন নাকি।
গুপ্তঃ আরে ভয় পাবেন না। আমরা সক্কলে আছি তো নাকি।
ফেলুদাঃ লালমোহনবাবু, আপনি অযথা ভয় পাবেন না। তারপর শুনুন, কিছুদিন আগে সৃজিত একটা সিনেমা করছে ফেলুদাকে নিয়ে, আর ভালো কথা জটায়ুকেও পেয়ে গেছে আর তোপসে তো থাকবেই। আমার কিন্তু আবির ছাড়াও এই ছেলেটাকে খুবই পছন্দ ছিলো ফেলুদার চরিত্রের জন্য, টোটা। এখনকার জেনারেশনের জন্য একদম ঠিকঠাক। তবে আবির নিজের পায়ে কুড়ুল নিজেই মারলো। শরদিন্দু বাবুর ব্যোমকেশ ওকে বেশ মানিয়েছিলো। কিন্তু ফেলুদা করতে গিয়েই যত বিপত্তি। যাক, সে নিয়ে আমার কাজ নেই। আমি আছি আমার নতুন ফেলুকে নিয়ে, টোটা। ইন্ডাস্ট্রি এতদিন ঠিক ভাবে ব্যবহার করেনি ওকে। বোধ হয় এবার সঠিক সিদ্ধান্ত।
লালুঃ তা আঙ্কেল একটু অপ্সরাদের নাচ দেখবেন নাকি? সাথে আরও কিছু ব্যবস্থা আছে। বোতল চলে নাকি।
গুপ্তঃ আহা লালু, ছ্যাবলানোটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। জটায়ুবাবু, প্লিজ কিছু মনে করবেন না। এই লালুটা একেবারে ছোটলোক। কাকে কি বলতে হয় জানে না।
সিধুঃ একাবারে ছ্যাঁচড়া। স্বভাবটা কোনোদিনও চেঞ্জ হবে না। এখানে এসেও যত আজেবাজে কান্ড করে।
লালুঃ ওরে প্যাংলা, তোকে দেখাচ্ছি মজা। (বলেই মাথায় এক গাঁট্টা)
সিধুঃ ভালো হবে না বলে দিচ্ছি লালু। খুন করে ফেলবো। 😡😡 😡😡
শ্যামঃ ওঃ কি হচ্ছে? তোদের ঝগড়া কি এখানেও চলছে। এখানে এসেও শান্তি নেই। তোরা জানিস না, মর্ত্যে কি হচ্ছে।
সকলে একত্রঃ কি হচ্ছে।
শ্যামঃ চল আমি ফেলুদার মতো করেই না হয় বলি।
ফেলুদাঃ দুনিয়াটা বুঝি শেষ হতে চললো। মানুষ মানুষে ভেদাভেদ। ভূপেনদার গানটা কেউ গায় না আজকাল "মানূষ মানুষের জন্যে", তাই বুঝি এই হানাহানি। তারপর পরিবেশের উপর অযত্ন। বাড়ির বড়দের সম্মান নেই। নেতারা নিজেদের আখের নিয়েই ব্যস্ত। সারা দুনিয়ায় এক মারণ রোগের জীবাণু হানা দিয়েছে, তারই জেরে বিশ্বসংসার অচল। মানুষের কাজ কর্ম নেই। সবই আজ অনলাইনে সীমাবদ্ধ। আমি এই বয়সে কাজে বেরোলাম। ব্যাস ছোট জীবাণু আমাকেও অ্যাটাক করলো। ৪১ দিন লড়লাম। বয়স হয়ে গেছে যে। তাই চলে এলাম তোদের কাছে।
ঠিক আছে এসে গেছি যখন, সবাই মিলে শান্তিতেই থাকবো। আমরা নতুন ভাবনায় মেতে উঠবো সবাইকে নিয়ে। থাকবো তো একসাথে নাকি?
সকলেঃ নিশ্চয়ই
ফেলুদাঃ আর অবশ্যই চাইবো, পৃথিবী ফিরে পাক তার স্বাভাবিক ছন্দ। মানুষ আবার মেতে উঠুক নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্মে, শিল্পকর্মে। সব কিছু নতুন ভাবে শুরু হোক ভেদাভেদ ভুলে, হিংসা-দ্বেষ ভুলে। মানবতার জয় হোক। এই কামনা করি। সকলে ভালো থাকুক।
🙏🙏🙏
- রাজকুমার ঘোষ
ফেলুদা তথা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এর সাথে বাকি সকল অভিনেতার প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য। 😍😍
প্রকাশিতঃ বরাহনগর সাহিত্য দর্পণ, ২০১৯ ... সৌমিত্র সংখ্যা
No comments:
Post a Comment