রাজকুমার ঘোষ
~ ১২.০৮.২০২২
জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা মাঝে মাঝেই স্মৃতির মধ্যে ভেসে ওঠে। সেই ভেসে যাওয়ার মধ্যে যদি গল্প থাকে অবশ্যই তা লিখে রাখা উচিত। এইরকমই একটি গল্প সকলের সাথে ভাগ করে নিতে ইচ্ছে হল। অনেক বছর আগে একটি ভিড় ট্রেনের গল্প মনে পড়ে গেল।
সদ্য কলেজ থেকে পাশ করে বেরিয়েছি। আর চাকরীর জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করতে শুরু করেছি। টেকনিক্যাল ফিল্ডের ছাত্র, কাজেই রেলের পরীক্ষা গুলোর জন্য আবেদন করতাম বেশি। রেলের টেকনিক্যাল ক্যাটেগরির জন্য ভারতবর্ষের বিভিন্ন রেলবোর্ডের আন্ডারে পরীক্ষা গুলো নেওয়া হতো। সে এখনো হচ্ছে। আমাদের সময় পাটনা রেল বোর্ডের আন্ডারে আমি দুটো ক্যাটেগরীর জন্য আবেদন করেছিলাম। দুটো ক্ষেত্র থেকেই অ্যাডমিট কার্ড চলে আসে। কাজেই পরীক্ষা দিতে হলে পাটনা ও মুঙ্গের যেতে হবে। এই পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় আমাকে দূরপাল্লার ট্রেন গুলোর ওপর নির্ভর করতে হত। রিজার্ভেশনের তোয়াক্কা না করেই আমি জেনারেল কম্পার্টমেন্টেই জার্ণি করতাম। বেশ মনে আছে। পাটনায় পরীক্ষাটা দেওয়া হয়ে গেছে। পরের পরীক্ষা মুঙ্গেরে হবে। পাটনা স্টেশন থেকে টিকিট কেটে মুঙ্গেরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে একটি এক্সপ্রেস ট্রেনের ( নাম মনে নেই) জেনারেল কামরায় উঠে পড়েছি। ওঃ কি যে বিশ্রীরকম অবস্থা ! এমন ভিড় আমার ধারণার বাইরে। কোনরকম ঠেলা, গোত্তা সামলে কামরায় উঠেছি আর একটা না বসেও বসার মতো জায়গা পেয়েছি সেটাও খুব ভাগ্যের ব্যাপার। তারপর বেশ কিছু মহিলা তাদের কিছু ছাগল আর মুরগী নিয়ে কামরায় উঠেছে। অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। ছাগল এবং মুরগীগুলোর সাথে একটা দুর্গন্ধ যেন পেটের ভেতরে থাকা খাবার গুলো নাড়িভুড়ি সমেত মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার মত অবস্থা। রীতিমত কোনঠাসা অবস্থা আমার। একটা সীটে আধবসা অবস্থায় বসে কামরায় উপস্থিত মানুষগুলোর থোবড়া গুলো আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখছি আর ভাবছি কোথায় পৌছব আমরা! তার ওপর আপার বার্থে থাকা কিছু উটকো পাবলিক তাদের ঠ্যাঙ দুটো মুখের সামনে ঝুলিয়ে বসে আছে। এরই মধ্যে কামরায় উঠেছে বেশ কিছু হিজড়া। তারা এসেই হাতে তালি দিয়ে সকলের থেকে টাকা-পয়সা চাইছে। তাদের মধ্যে একজন এসে হাত বাড়িয়ে আমাকে বলল, "এ বাবুয়া"। আমি কথা না বাড়িয়ে বেশ ভয় পেয়ে পকেটে যা ছিল দিয়ে দিলাম। আমার পকেটে বোধ হয় কুড়ি কি পঞ্চাশ টাকার নোট ছিল। সেটাই চলে গেছে। আমি দেখিওনি। হিজড়াটি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, "ভগবান তেরা ভালা করে"। এই ব্যাপারটা খেয়াল করেছিল কিছু চ্যাংড়ামী করা বিহারী ছেলে। যাদের বলা যেতে পারে একটা গ্যাং। সেটা টের পেলাম ট্রেনে ওদের বাঁদরামী দেখে। কেন জানিনা আমাকে দেখে ওদের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। আমার জামার পকেট ধরে ওরা টানাটানি করতে লাগল। ওদের মধ্যে একজন এসে আমাকে শাসিয়ে বলল,
-"ক্যায়া রে মনুয়া, বহুত দিলদার হে তু, কুছ তো হাম লোগোকে লিয়ে ভি রাখনা চাহিয়ে"।
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কোনোরকমে মুখ দিয়ে বেরোলো,
- "ছোড় দো মুঝে। মেরে সাথ আচ্ছা নেহি কর রহে হো"।
- "ক্যায়া কর লেগা তু, মনুয়া। আগর আপনা ভালা চাতে হো, তো সবকুছ দে দো
এই বলে ওরা চারজন আমার কাছে এসে আমাকে উল্টোপাল্টা কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল, আমার পকেট, লাগেজ দেখতে যাবে কি ! কোথা থেকে সেই হিজড়া এসে ওদের একজনকে সপাটে পেটে লাথি মারলো। ওদের আরো জনা-দশেক সাথী ছিল, তাদেরকেও সে ডেকে নিলো। তারপর রীতিমত ট্রেনে খন্ডযুদ্ধ। হিজড়াদের দাপটে ওই বাঁদরগুলো কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সেই হিজড়া যে আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিল সে আমাকে আশ্বাস দিল, “এ বাবুয়া, ডরো মত, হাম সব পাশ হ্যায়, তু ভালা লেড়কা হ্যায়। হাম সব ভালাকে সাথ”। ওই সময় সত্যি ! আমার দু’চোখ বেয়ে জল চলে এলো । নিজের মনে মনে বললাম, ‘ভগবান, তুমি সত্যি, কতো রূপে আছো’ । ঘটনার পর আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম, যে না চাইলেও আমার ঘুম পাচ্ছিল। হিজড়া জানতে চাইল, কতদূর যাব আমি? আমি মুঙ্গেরে যাব জানাতে সে আশ্বস্ত করল তারাও যাবে বেগুসরাই। সুতরাং চিন্তা করতে মানা করল। আমাকে ভালো একটা বসার সিট পাইয়ে দিল এবং বলল, "শো যা বেটা"। আমি সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম সিটে বসে। ঠিক মুঙ্গের স্টেশনে আসার মিনিট পাঁচ আগে আমাকে ডেকে দিল, “বেটা উঠো, মুঙ্গের আগেয়ে” – আমি উঠে পড়লাম। তারপর স্টেশনে ট্রেন আসতেই ওরা আমার লাগেজ বের করে প্লাটফর্মে নামাল। আমাকে আশীর্বাদ করল। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম থেকে চলে যাওয়ার আগে বলল, “টাটা বেটা”। আমি হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। আর ভাবতে লাগলাম কিছুক্ষণ আগে ভিড় ট্রেনের ফেলে আসে মুহূর্তগুলো। যা আজও আমার স্মৃতিপটে একটি উজ্জ্বলপাতা হয়ে রয়ে আছে। মানবতার প্রতীক হিসাবে আমি সেই হিজড়াকে ভগবানের দূত বলতেও দু’বার ভাবিনা ।
No comments:
Post a Comment