Thursday, August 11, 2022

অচেনা শহর পাটনা


রাজকুমার ঘোষ 

# ১১-০৮-২০২২ 

জীবনের পঁয়ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আজ রাখি পূর্ণিমার দিনে রাজীববাবু বাড়ির বারান্দায় বসে পঁয়ত্রিশ বছর আগের একটি সুখস্মৃতি ভাবছে, যা তাঁর মণিকোঠায় এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে। তখন কাজের সূত্রে প্রথমবার তিনি পাটনা গেছেন। অচেনা শহর, কাউকেই চেনেন না। পাটনার সাউথ গান্ধী ময়দানের কাছে একটি হোটেলে ছিলেন। সেখান থেকে ভীষণ কাছেই একটি সংস্থার অফিসে ওনার কাছ ছিল। সেই অফিসের মেন বস আহমেদ আলীর সাথে রাজীব বাবুর পরিচয় হয়। প্রায় সপ্তাহখানেক পাটনায় থাকতে হবে এবং কাজগুলো সম্পূর্ণ করে তবেই বাড়ি ফিরতে পারবেন। যথেষ্ট চাপের কাজ। এছাড়া পাটনা শহর হিসাবে অশান্ত৷ রাজীব বাবুর কাছে পাটনা নাম শোনা মাত্রই ভীষণ অস্বস্তি। তবুও কাজের জন্যে আসতেই হল।  সেই সময় যখন তখন পাটনার রাস্তাঘাটে হত্যালীলা চলত, তার খবর নিউজ পেপারে হামেশাই প্রকাশিত হত। এমন একটি অশান্ত শহর পাটনায় রাজীব বাবুর দু'দিন কাটাতেই যেন প্রাণ ওষ্ঠাগত, তার ওপর এক সপ্তাহ থাকতে হবে। কাজের ক্ষেত্র একজায়গায় নয়। বিভিন্ন শাখা অফিস যেমন, রাঁচি, হাতিয়া, মুজফফরপুর, হাজিপুর, মুঙ্গের, বেগুসরাই, নামকুম, টাটা প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হবে। সাথী হিসাবে থাকবেন আহমেদ আলী বা কখনো কখনো আহমেদ আলীর এক ঘনিষ্ট বন্ধু ঈদ্রিশ আলী। এই ঈদ্রিশ আলীর নিজস্ব একটি ব্যাটারী সেন্টার আছে। বেশ বড় বিজনেসম্যান। তারচেয়েও বড় কথা, ঈদ্রশ আলী এক বড়ধরণের গুণ্ডা। তার সাথে অনেক নেতা-পুলিশের চেনা জানা। কাউকে খুন করে লাশ গুম করে দেওয়া ঈদ্রিশের বাঁ হাতের খেল। ঈদ্রিশের এই ব্যাপারটা ওর সাথে প্রথম দর্শন বা ওপর ওপর মেলামেশা করলে কেউ বুঝতে পারবে না। রাজীব বাবু এমনিতে বেশ খোলামেলা এবং বন্ধু বৎসল। সকলের সাথে খুব সহজেই মিশে যান। প্রায় সপ্তাহ খানেক আহমেদ ও ঈদ্রিশের সাথে বিভিন্ন জায়গায় একসাথে ঘোরা, কাজ করা এবং অবশ্যই রাজীববাবুর ব্যবহারে ওরা দুই আলী ভীষণ মুগ্ধ। মাত্র কদিনেই রাজীববাবুকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো, প্রতিদিনের কাজের পরে টুকটাক আড্ডা, গল্প গুজবে সময় কাটানো সবই হয়েছে। ক'দিনেই এই অচেনা পাটনাতে রাজীববাবুর দু'জন বন্ধু জুটে গিয়েছিল। একদিন একটি বাঙালী হোটেলে লাঞ্চের সময় কথোপকথনে রাজীব বাবু জানতে পারলেন ঈদ্রিশের আসল পরিচয়,

হোটেলে রাজীব বাবু তিনটে মাছ-ভাত এর অর্ডার দিয়েছিলেন,

- দেখিয়ে আহমেদ ভাই, ঈদ্রিশ ভাই, আজ বাঙালী হোটেল মে বাঙালী খানা, মছলি-ভাত মেরে সাথ লাঞ্চ কর লিজিয়ে।

- আরে দাদা, হামলোগ কো আচ্ছা লাগতে হেয় ইয়ে মছলি ভাত। হামরা ভালো বাঙলা জানি রাজীবদা। বাঙলা ভাষা মিঠা আছে। আর বাঙালিদের সাথেই আমাদের কোম্পানির কাজ বেশি করতে হয়। এই কোম্পানির মালিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অনেকেই বাঙালি।

- বাহ শুনে খুব ভালো লাগল। আহমেদ ভাই। কদিনে আপনাদের সাথে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এবার পাটনা এলেই আপনাদের সাথে যোগাযোগ করব।

- একদম দাদা।

সেইসময় একজন ষণ্ডামার্কা লোক, ঈদ্রিশের কাছে এলো। কানে কানে কি যেন বলল, তারপর ঈদ্রিশ অর্ধেক খাওয়া ভাত-মাছ রেখে সেই লোকটার সাথে চলে যাওয়ার আগে রাজীববাবুকে বলল,

- দাদা প্লিজ। ডোন্ট মাইন্ড। একটো কাজ এসে গেছে, তুরন্ত যেতে হবে। ফির কভি।

অগত্যা রাজীব বাবু মেনে নিলেন। আহমেদ আলীর সাথে বসে লাঞ্চটা সেড়ে নিলেন। লাঞ্চ করতে করতেই আহমেদ আলী রাজীববাবুকে জানাল ঈদ্রিশের সম্বন্ধে। এখানকার নেতা-মন্ত্রী, পুলিশ কর্তাদের সাথে ঈদ্রিশের দারুণ কানেকশন। আহমেদ আলী জানায়, এই ঈদ্রিশের জন্যই সে পাটনায় আছে। ওর বাড়ি দেওঘরে। পাটনায় দারুণ ভাবে সেটল হয়ে থাকার জন্য একমাত্র ঈদ্রিশের অবদান। ঈদ্রিশ যেমন পরোপকারী, তেমনি বিপজ্জনক। ভালো মানুষের জন্য খুবই ভালো, খারাপ মানুষের জন্য খুবই খারাপ। এসব শুনে রাজীব বাবুর চক্ষু চড়কগাছ। আহমেদ আলী সেটা বুঝতে পেরে বলে,

- আরে রাজীবদা, আপনি ডরবেন না। আপনি ভীষণ ভালো মানুষ, মাই ডিয়ার লোক আছেন। ঈদ্রিশ আপনাকে খুব রেসপেক্ট করে।

পাঁচদিনের মাথায় রাজীববাবু রাঁচিতে কাজ করতে গেলেন। দুদিন ওখানে কাজ সেরে রাজীববাবু রাঁচি থেকে রাত ৮টার বাস ধরে পাটনায় ফিরে এলেন। বাস থেকে নামলেন রাত ১২টা ১০ মিনিটে। পাটনার সাউথ গান্ধী ময়দান সংলগ্ন সমস্ত রাস্তা শুনশান। অল্প রাস্তা পায়ে হেঁটে মাত্র ৩ মিনিট। ফাঁকা রাস্তা ধরে রাজীব বাবু পূর্ব পরিচিত হোটেলে ফিরে এলেন বটে, কিন্তু এই তিন মিনিটের মধ্যেই যেন ঘেমে অস্থির। হোটেলের রিসেপশনে যিনি ছিলেন,

- রাজীব স্যার আইয়ে আইয়ে ...

- হ্যাঁ, বহুত লেট হো গ্যায়া। রাত মে ইয়ে সাউথ গান্ধী ময়দান শুনশান। ডর গ্যায়া বহুত। প্লিজ রুম কি চাবি দি জিয়ে ভাই।

- জরুর। কুচ খানা আপকে লিয়ে...

- হুম ভুক তো লাগ রাহা হে। মেরে লিয়ে তিন রুটি, সবজি অর এক আণ্ডা ফ্রাই। কুছ রুপিয়া রাখ লিজিয়ে।

রাজীব বাবু প্যান্টের পেছন পকেটে হাত দিতে গিয়েই দেখে যে মানি ব্যাগ নেই। এই মানি ব্যাগেই তার সমস্ত টাকা ছিল। ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লেন।

- ভাইয়া, বহুত বুড়া হুয়া মেরে সাথ। মেরা পার্স কোই উঠা লিয়া পকেট সে। সব রুপিয়া উসি মে থা। মেরা সমজমে কুছ নেহি আরা হে। ক্যায়া করু

- আপ শান্ত হো যাইয়ে পেহেলে। ঠান্ডে দিমাগ রাখিয়ে প্লিজ। পেহেলে আপ রুমে মে যাইয়ে। ম্যায় আপকে লিয়ে খানা ভেজতা হু।

- ঠিক হ্যায়। বহুত ট্যায়ার্ড হু। কাল শুভা কুছ করতা হু।

সেদিন কোনোরকমে কিছু মুখে দিয়ে রাজীব বাবু একরাশ মন খারাপ নিয়ে হোটেলের ঘরে ঘুমিয়ে গেলেন। উঠে পড়লেন খুব সকাল সকাল। উঠেই ছুটলেন আহমেদ আলীর সাথে দেখা করতে।

- আহমেদ ভাই, আমার সব টাকা পকেটমারী হয়ে গেছে।

- কি বলেন দাদা। এতো রুপিয়া পকেটে লিয়ে ঘুমবার কি দরকার ছিল। কুছ রুপিয়া আলাগ সে রাখতে পারতেন তো।

- জীবনে এই প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতা হল। কি করে জানবো, আমার সাথেই এমন হবে। আমি বাড়ি যেতে পারবো না, আপনারা সাহায্য না করলে। আর আমাকে আজই রাতের ট্রেন ধরতে হবে। কাল রাখী পূর্ণিমা আছে। বোন অপেক্ষা করবে। আমাকে রাখী না পরিয়ে সে কিন্তু খাবেই না। কি যে করি, মাথায় কিছু আসছে না আহমেদ ভাই।

- এতো তকলিফ নেবেন না দাদা ... প্লিজ। ঈদ্রিশ থাকতে আপনার চিন্তা কিসের...

একজনকে দিয়ে ঈদ্রিশের কাছে খবর পাঠাল আহমেদ। প্রায় দশ মিনিট পর ঈদ্রিশ হন্তদন্ত হয়ে চলে এল। এসেই রাজীববাবুকে জিজ্ঞেস করলেন,

- শুনলাম দাদা, আপ তকলিফ মে ...

- আরে দাদার পিক পকেট হো গ্যায়া। সব রুপিয়া গায়েব। - আহমেদ জানাল।

- হ্যাঁ ঈদ্রিশ ভাই, কাল রাঁচি থেকে পাটনায় ফেরার পথে আমার পকেট থেকে মানি ব্যাগ গুম হয়ে গেছে। আমার কাছে একরুপিয়াও নেই। আজ রাতে বাড়ি ফিরতেই হবে। কাল রাখী পূর্ণিমা মানে রক্ষা বন্ধন আছে। বোন অপেক্ষা করবে। ফেরার টিকিট মানি ব্যাগেই ছিল। কি হবে?

- আরে দাদা, এই ঈদ্রিশ ভাই আছে যখন, একদম টেনশন নেবেন না। আমার ভালো লাগবে আপনার মত ভালো মানুষের কাজে লাগতে পারলে। একদম টেনশন নেবেন না। পেহেলে আপনার জন্য টিকিট যোগাড় করি চলুন।

এই বলেই ঈদ্রিশ রাজীববাবুকে সাথে নিয়ে চললেন টিকিট বুকিং কাউন্টারে। সেখানে যে টিকিট কাটছিল সে জানাল, রিজার্ভেশন নেই, হবে না। ঈদ্রিশ আলী এরপর তার কানে কানে কি একটা বলল, তার কিছুক্ষণ পরেই লোকটা রাজীববাবুর থেকে ডিটেলস নিল, এবং একটা রিজার্ভেশন টিকিট রাজীববাবুর হাতে ধরিয়ে দিল। রাজীব বাবু কার্যত অবাক। এরপর সেখান থেকে রাজীববাবুকে নিয়ে ঈদ্রিশ আলী ফিরে এল হোটেলে। এসে হোটেলের সমস্ত টাকা মিটিয়ে দিল। এরপর রাজীববাবুর হাতে বেশ কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

- আমি রাতে এসে আপনাকে স্টেশনে পৌঁছে দেব। আপনি রেডি থাকবেন।

- ঈদ্রিশ ভাই, থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনার এই উপকার একদম ভুলবো না। কিন্তু আপনার টাকা কিভাবে দেবো ...

- বোহিনের কাছে ভাইকে পাঠানোর দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন টাকার কথা না ভেবেই নিয়েছি দাদা। আমার বোন ছিল, সে এখন নেই। সে অনেক কথা। বলে আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না। পরে যখন সুযোগ হবে নিশ্চই জানাবো। আপনি সাবধানে বাড়ি ফিরে যান এটাই আমার চাওয়া।

- অবশ্যই কলকাতা আসবেন ঈদ্রিশ ভাই। খুব ভালো লাগল আপনাদের সাথে পেয়ে। আগামীদিনে হয়তো দেখা নাও হতে পারে, কিন্তু আমার বন্ধুর তালিকায় আপনি সারাজীবন থেকে গেলেন। আর রক্ষা বন্ধনের ভালোবাসা নেবেন আমার ও বোনের তরফ থেকে।

সেদিন কথা মতো ঈদ্রিশ ভাই রাজীব বাবুকে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছিলেন। রাখী পূর্ণিমার দিনে সকালে বাড়িতে পৌঁছেই রাজীববাবু বাড়ির সবাইকে জানালেন সমস্ত ঘটনা। বোনকে বললেন, সেই মানুষটার কথা ভাব, তার উদ্দেশ্যেও একটা রাখী নিয়ে ভগবানের হাতে পড়িয়ে দিস বোন। শুধুমাত্র তার জন্যই আজ তোর দাদাকে তুই কাছে পেলি।

আজ পঁয়ত্রিশ বছর পরেও ট্রেন ছাড়বার মুহূর্তে ঈদ্রিশ আলীর সেই চোখ ছল ছল মুখ রাজীব বাবুর এখনও মনে আছে। না এরপর ঈদ্রিশ ভাই এর সাথে কোনোদিন দেখা হয়নি রাজীববাবুর। তবে রাজীববাবু দায়িত্ব সহকারে ঈদ্রিশের ঠিকানায় একটি ব্যাঙ্ক ড্রাফট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মনে মনে রাজীব বাবু বললেন, "সেদিনের সেই অচেনা পাটনা শহরের পরিত্রাতা তুমি, ঈদ্রিশ ভাই। তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থাকো।"

3 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো গল্পটা । প্রথমটা একটু টেনশন হচ্ছিল গল্পটা কোনদিকে মোড় নেবে ভেবে । শেষ পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. পরম প্রাপ্তি। এই যে এমন উৎকন্ঠা, ভাবনা, আমার লেখাকে আরও মোটিভেট করবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই ।

      Delete
    2. ও আমি রাজকুমার ম্যাম ... আমাদের পদক্ষেপ পরিবারের একজন, তাই এই নামে কমেন্ট করি

      Delete