রাজকুমার ঘোষ
অনেক পুরোনো মধুর
স্মৃতি নিয়ে প্রায় এক যুগ পর গ্রামে আসছে ডাঃ সাগর চট্টোপাধ্যায়। শিকড়ের টান যে
তাকে বারেবারে হাতছানি দেয়নি তা নয়, সে তো আসতে চায় তার ছোটবেলায় কাটিয়ে যাওয়া এই হরিশপুর গ্রামে। তাদের
রাজকীয় বসতবাড়ী, তার সাথে সংলগ্ন সবুজে ঘেরা গ্রাম্য জগৎ,
চারিপাশে যেদিকে তাকায় ধান, সরিষার
ক্ষেত, দু তিনটে পুকুর, ঠাকুর
দালান এবং সর্বোপরি তার বাল্যবন্ধুদের সাথে কত আড্ডা... আজ শুধু স্মৃতির মণিকোঠায়
জ্বলজ্বল করছে। গ্রামের রাস্তা ধরে তার বিলাস বহুল গাড়িটা যখন তাদের বসত বাড়ির
দিকে ঢুকছে, সকলে অবাক পাণে তাকিয়ে রয়েছে... ছোট ছোট
ছেলেগুলো হৈ হৈ করে গাড়িটির পেছনে ছুটে চলেছে। সাগর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে
পড়েছে, তার পাশে থাকা স্ত্রী রমা ও ছেলে রকিকে তার
গ্রামের কথা মুগ্ধ নয়নে বলে চলেছে। বাড়ির সামনে আসা মাত্রই সাগরের ছোটকাকা
নারায়নবাবু বেড়িয়ে এলেন, তার সাথে ছিল তার ছোটবেলার দুই
বন্ধু শিবেশ ও উমাপতি। সাগর এদের সাথে তার স্ত্রী ও ছেলের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
দুপুরে খাওয়া শেষে সাগর দুই বন্ধু শিবেশ ও উমাপতিকে
নিয়ে বসলেন বাড়ির বৈঠক খানায়, যেখানে বসে একসময় দাদু, বাবা কাকারা গ্রামের
উন্নয়নের জন্য গ্রামের লোকেদের সাথে কথা বলতেন। সেখানে বসে ওরা ওদের ছোটবেলায় ফিরে
গেলেন নিমেষে। একে একে তারা বলতে লাগল স্কুলে যাবার সময় পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরা...
ডাংগুলির ম্যাচ, এর ওর গাছে ভালো কিছু ফল পেলেই সেগুলো
নিজের করে নেওয়া এবং পুজো পার্বনগুলোয় একসাথে চুটিয়ে আড্ডা... মেলায় যাওয়া,
কতরকম খাওয়া-দাওয়া এবং খেলা কেনা সবকিছু। এতকিছুর মধ্যেও সাগর
ভোলেনি সেইসময় গ্রামের খুবই পুরোনো লোক হরিদাদুর কথা, এই
দাদুর সাথে ওদের সম্পর্ক খুবই নিবিড় ... যাকে বলে আদা-কাঁচকলায়... সেই সময় সাগরের
পয়লা নম্বর শত্রু ছিল এই হরিদাদু... সেই প্রসঙ্গেই সাগর শিবেশকে –
- হরিদাদুর কথা কিন্তু আমি এখনো
ভুলিনি
- তোর হরিবুড়োর কথা মনে আছে?
- মনে আবার থাকবে না? ছোটবেলার চরম শত্রুকে কেউ ভোলে? দাদুর কি খবর?
উমাপতি বলে –
- হরিদাদুর ছেলেপুলে তো কেউ ছিলো
না। দুই মেয়ের বিয়ে তো সে কোন কালে হয়ে গেছে? শেষ বয়সে
পাগল হয়ে যায়। দেখার কেউ ছিলো না, তোর বাবাই সেই দায়িত্ব
নেয়। ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। ওনার সম্পত্তি ওনার আত্মীয়রা এসে কোনো একজনকে
বিক্রি করে দেয়।
সাগর খেয়াল করেছে হরিদাদুর বসতবাড়ীটা বেশ সাজানো
গোছানো। ওর মনে আছে বাড়ির বাগানে আমগাছগুলো ছিলো, ভালো আম হত সেখানে, ওরা সেই
আমগুলো গাছে উঠে পেড়ে নিতো। পেয়ারাগাছ গুলোতে বেশ ডাঁসা পেয়ারা থাকতো। একদিন দাদুর
হাতে সাগর ধরা পরে গিয়েছিলো। ওর বাবাকে দাদু নালিশ করেছিলো এবং তার জন্যে বেধরক
ঠ্যাঙানি দিয়েছিলো। তা মনে করেই সাগর –
- মনে আছে বাবাকে নালিশ করে দাদু
আমাকে ঠ্যাঙানি খাইয়েছিল।
শিবেশ বলল- সে আবার মনে থাকবে না? তারপর বদলা নেবার প্ল্যান কেমন নিলাম
এবং সফলও হলাম।
এইসময় রমা প্রবেশ করল হাতে চা এর ট্রে নিয়ে
– বদলা! কার জন্য বদলা আর কিসের
প্ল্যান!
- বৌদি, ছোটবেলার
স্মৃতিচারণ... সে এক দিন ছিল, আমরা তিনজন সেইদিন গুলোর
কথা মনে করছি।
- তা আমাকেও কি বলা যায় না?
উমাপতি বলল-
নিশ্চয়ই, শুনুন তবে.........
তখন সাগর আর ওর বন্ধুরা মিলে পাশের বাড়ির হরিদাদুর
বাগানের গাছ থেকে আম, পেয়াড়া
চুরি করতে গিয়ে একদিন হরিদাদুর হাতে ধরা পড়ে গেলো। হরিদাদু সাগরের বাবাকে নালিশ
করাতে ওর বাবা সেদিন ওকে প্রচন্ড ঠাঙানি দিয়েছিল। সাগর তারই বদলা নিয়েছিল।
সেইসময় প্রতিদিন ভোরবেলায় দাদু বাগান সংলগ্ন পুকুরে
স্নান করতো, স্নান করার
পর সূর্য প্রণাম করত। দাদু তার আন্ডার প্যান্টটা রাখতো পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে,
সেই সুযোগটা সাগররা কাজে লাগিয়েছিল। সাগর বেছে বেছে অনেক কাঠ
পিঁপড়ে যোগাড় করেছিল। কোন একটা দিন দাদু যখন পুকুরের জলে ডুব দিয়ে উঠে সূর্য
প্রণাম করছিল, ঠিক সেইসময় ও গোটা দশেক পিঁপড়ে দাদুর
আন্ডার প্যাণ্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ব্যাস তারপর দেখে কে! স্নান করার পর দাদু
তার আন্ডারপ্যান্ট পড়ল, কিছুক্ষণ পরেই দাদুর ভয়ংকর রকম
লাফালাফি শুরু, দাদু কোনরকমে প্যান্টটা ছেড়ে সাগরের
বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল তারপর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এরপর সাগরের বাবা দাদুর চিকিৎসার
ব্যবস্থা করলেন। দাদু প্রায় পাঁচদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি। পরে জেনেছিল
ব্যাপারটা কি, এবং সাগরকে ওর বাবা তার উপযুক্ত শাস্তিও
দিয়েছিলেন।
রমা সাগরের দিকে তাকিয়ে- তুমি এতটা দুষ্টু ছিলে? ভাবা যায় না। এখন রকিকে শাসন কর...
সত্যি! ভাগ্যিস এখানে এলাম তাই জানতে পারলাম।
- বৌদি আরো আছে... অবাক হওয়ার
কিছুই নেই। - উমাপতি বলা শুরু করল...
এরপর সাগর শাস্তি পেয়ে শান্ত একদমই হলো না বরং ও আরো
বেশী জেদী হয়ে গেল। রাগে ও আরো ভয়ংকর কিছু প্ল্যান করতে লাগলো এবং তা করে ফেললো। ও
গ্রামের হাট থেকে লঙ্কা গুড়ো নিয়ে এলো। দাদু নস্যি নিতো, একদিন দাদুর বাড়িতে গিয়ে নস্যির
ডিব্বার মধ্যে লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে দিল। দাদু যেই নস্যি নাকে নিয়েছে, আর দেখতে নেই, হেঁচে হেঁচে তার চোখ মুখ লাল
হয়ে গেলো এবং তার নাক ফুলে ঢোল হয়ে গেল। প্রায় সপ্তাহ খানেক দাদু বিছানা ছেড়ে উঠতে
পারেনি। সাগরের বাবা এরপর ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সাগর রাগে ওর মামাবাড়ি চলে
গেল। প্রায় চার মাস পর কালিপুজোর আগে ওর বাবাই ওকে নিয়ে আসে।
কালীপুজোর পর এসে সাগরের নতুন প্ল্যান হলো ছুচোবাজি
তৈরী করে একটু নতুন ধরনের বদলা। হরিদাদু রাত ন’টায় খেয়ে নিয়ে শোবার জন্য লুঙ্গি পালটে শুতে যায়। সাগর
একটা ছুচোবাজি জ্বালিয়ে দাদুর সেই লুঙ্গি তাক করে ছেড়ে দেয়। সেই ছুচোবাজি সোজা
গিয়ে দাদুর লুঙ্গির ভেতরে ঢুকে যায়। রাতবিরেতে সে এক ধুন্ধুমার কান্ড। সাগরের
বাবা-কাকারা ছুটে গিয়ে দাদুকে ধরে ফেলে কম্বল চাপিয়ে দেয়। দাদুর যা হবার তা হয়ে
গেছে। এরপর ওর বাবা সাগরের ওপর ভীষণ রেগে গিয়ে ঐ দিন রাতেই ঘর থেকে বের করে দেয়।
সাগর সারারাত ঘরের বাইরে কাটায়। এমনকি কোন বন্ধুর বাড়িতেও যেতে চায়নি। পরের দিন
সাগরের বাবা বললেন, ‘ও আমাদের বাড়ির কুলাঙ্গার, ওর শিক্ষা হবে না। ওকে হোস্টেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি’। ওকে রহড়া রামকৃষ্ণে ভর্তি করে দেয়। সেই যে সাগর গ্রামছাড়া হল,
এতদিন পর ও ফিরে এলো।
প্রায় দশ মিনিটের মতো এরপর নিস্তব্ধতা। উমাপতি ও
শিবেশের কাছে রমা সাগরের এই কীর্তিকলাপ শুনে যারপরনাই হতভম্ব। সাগরই সেই
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলল - এরপরের ঘটনাগুলো এবার আমাকে বলতে দে। এতক্ষণ ধরে তোরা
সব বললি......
সাগরের বাবা ওকে রহড়ায় রেখে চলে আসেন। পুরো স্কুল
লাইফটা সাগর ওখানেই কাটিয়ে দেয়। ওখানে ভালো রেজাল্ট করে ওর ডাক্তারী নিয়ে পড়ার
ইচ্ছা ছিল কিন্তু সেইসময় ওর বাবা-কাকাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। সেইসময়
হরিদাদু প্রায়ই সাগরের বাবার কাছে ওর খোঁজখবর নিতেন। একদিন ওর বাবার সাথে ওর কাছে
এসেওছিলেন, ওকে গ্রামে
নিয়ে যাবার জন্য বলেওছিলেন। কিন্তু সাগর আর ফিরে যায়নি। সেদিন রাতের ঘটনার পর ওর
বাবার ‘কুলাঙ্গার’ শব্দটা ওকে
ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। ঠিকই করেছিল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েই গ্রামে ফিরবে। স্কুলে ভালো
রেজাল্ট করার পর ও একটা স্কলারশিপ পেয়েছিল, যেটা হল
রাশিয়ার একটা নামকরা কলেজে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ। ওখানে যাবার খরচা ও প্রাথমিক
অ্যাডমিশনের জন্য বিরাট অঙ্কের টাকার প্রয়োজন ছিল। বাকি ওখানে পাঁচ বছর পড়াশোনা
এবং থাকার খরচা ওদের। এইরকম সুযোগ বারবার আসেনা। ওর বাবা অনেক চেষ্টা করেও তা
যোগাড় করতে পারেনি। এরপর হরিদাদু এগিয়ে আসে, ওর বাবাকে
বলে নাতির ভালোর জন্য ওনার বসতবাড়িটা বিক্রি করতে চায়। ওর বাবা রাজি হয়নি। কিন্তু
হরিদাদু নাছোড়বান্দা। শেষমেষ হরিদাদুর সৌজন্যে সাগর রাশিয়ায় যায়।
সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সাগরের কাছে এতো কিছু
শোনার পরে। এরপর সাগর বলে - এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না। তাই এসে আমি
তোদের কাছে হরিদাদুর কথা বারবার শুনতে চেয়েছি । রাশিয়ায় যাবার পর আমার জগত অন্যরকম
হয়ে যায়। সেভাবে কারোর খোঁজ খবর নিতে পারিনি। বাবার সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ
রাখতাম। তোরাও আমাকে ক্ষমা করিস। আমি তোদের কারোর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি।
ডাক্তারী পাশ করার পর আমি ওখানে একবছর এক হাসপাতালে প্র্যাক্টিস করি। তারপর আমি
ফিরে আসি কলকাতায়। বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আর গ্রামেও আসা হয়ে ওঠেনি।
শিবেশ বলল,
- তুই আমাদের খবর না রাখলে কি হবে।
আমরা রাখি। আমাদের বন্ধু ডাঃ সাগর চট্টোপাধ্যায় কলকাতার একজন প্রথম সারির হার্ট
সার্জেন, সেটা কি জানি না ভেবেছিস। তুই যে এখানে এসেছিস
শেষপর্যন্ত সেটাই আমাদের কাছে অনেক। তুই আমাদের গ্রামের গর্ব রে।
- এবারে কালীপুজো আমরা সবাই ধুমধাম
করে পালন করবো। আমাদের বাড়ি, হরিদাদুর বাড়ি আলোয় ঝলমল
করবে এটাই আমার ইচ্ছা। এরজন্য যত খরচ হবে আমি দেবো। তোরা থাকিস আমার সাথে। আজ যা
কিছু আমি সব এই হরিদাদুর জন্য। আর একটা কথা বলি, হরিদাদুর
বাড়িটা আমারই এখন কেনা। এখন যারা আছে তারা এই বাড়িটার দেখাশোনা করে। আমার একবন্ধু
সব ব্যবস্থা করেছে। আজ এই বাড়িটা আমি রমাকে উপহার দিতে চাই।
ওর এই কথা শুনে সবাই হতবাক। রমা, শিবেশ এবং উমাপতি ভাবতে পারছে না।
সবাই ওকে জিজ্ঞেস করল, “ব্যাপার কি?”
- আজ থাক, অনেক বেলা হয়েছে। কাল কালীপুজোর দিনে হরিদাদুর বাড়িতেই না হয় চমক দেবো
সকলকে। একটু ধৈর্য ধর সকলে।
সকলে চমকের প্রতিক্ষা করে যে যার কাজে লেগে পড়লো। ইলেক্ট্রিসিয়ানকে
খবর দেওয়া হল। হরিদাদুর বাড়ি সমেত সারাবাড়ি আলোয় রাঙিয়ে তোলা হল। বাড়ির ঐ
বৈঠকখানায় কালী ঠাকুরও আনা হল। বেশ জমজমাটি আয়োজন করা হলো। সাগর ওর কাকাকে বলে
দিয়েছিল, যতটা সম্ভব হয়
পাড়ার লোকজনকে নেমন্তন্ন করে আসতে। কালীপুজোর দিন সকাল থেকেই বাড়িতে রমরমে ব্যাপার,
অনেক লোকের সমাগম। সকলে মিলিতভাবে পুজোর প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত।
সাগর ওর ড্রাইভারকে দিয়ে শহর থেকে অনেক বাজি আনিয়ে নিয়েছিল। সন্ধ্যের সময় ওদের
বাড়ির আকাশ আলোকসজ্জায় ঝলমল করে উঠল। তারই মধ্যে রমা, উমাপতি
আর শিবেশের মাথায় সেই চমকের ব্যাপারটা ঘোরাফেরা করছে। রমা বলেই ফেললো সাগরকে,
“কিগো আমার তো তর সইছে না, কখন বলবে?”
- গিন্নী, একটু সবুর তো কর। রাত ৮টা নাগাদ আমরা হরিদাদুর বাড়ি যাবো। সেখানেই না
হয় বলব।
- দূর ভাল্লাগে না।
সাগর মুচকি হেসে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সন্ধ্যে
৬টার মধ্যেই পুজোর সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। রাত ১১টায় পুজোর সময়, সন্ধ্যে ৭টার সময় সাগর তার কাকা
নারায়নবাবু, শিবেশ, উমাপতি এবং
রমাকে নিয়ে হরিদাদুর বাড়ি গেলো। সেই বাড়িতে এক স্বামী-স্ত্রী থাকতো। মুলত তারাই
বাড়িটার দেখাশোনা করতো। তারা সেভাবে পাড়ার কারোর সাথে মিশতো না। শুধুমাত্র সাগরের
কাকার সাথে যোগাযোগ ছিল। ওদের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলো। এরপর সাগর বলতে শুরু
করলো-
- কাকা, তুমি
বলবে নাকি আমি বলব। বাবা মারা যাবার পর কাকাই আমার সমস্ত কিছু দায়িত্ব নিয়েছে।
- কি যে বলিস খোকা। আমার নিজের
ছেলে বা মেয়ে নেই। তোর কাকিমাও কবে ছেড়ে চলে গেছে আমাকে। তুই তো আমারই ছেলে নাকি।
তোর বাবা মারা যাবার পর আমাকেই সব দায়িত্ব দিয়ে গেছে। সেই দায়িত্বতো পালন করতে হবে
নাকি
- ঠিক আছে কাকা। এই বলে সাগর বলতে
শুরু করল ......
হরিদাদুর দুই মেয়ে ছিল, যারা আজ এই দুনিয়ায় নেই। হরিদাদু তার
বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু বিয়ের এক বছর পরেই সেই
মেয়ে মারা যায়। দাদু তার ছোটমেয়ে শিখাকে বেশি ভালোবাসত। শিখা পড়াশোনা করেছিল।
স্কুলের বারো ক্লাসে পড়ার সময় একটি ছেলের সাথে প্রেম হয়। দাদুকে না জানিয়েই তারা
বিয়ে করে পালিয়ে যায়। দাদু ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। সেইসময়
সাগরের বাবা দাদুর দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলো। সাগরের বাবা-কাকাকে দাদু নিজের
ছেলের মতো করে ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসার জন্যই দাদু সাগরকে রাশিয়ায় ডাক্তারী
পড়ানোর জন্য বাড়ি বিক্রি করার কথা দু’বার ভাবেননি। দাদুর
ছোট মেয়ে শিখা ফিরে আসেনি। সেক্ষেত্রে দাদুর সম্পত্তির উত্তরাধিকার বলতে কেউই ছিলো
না। তখন দাদুর এই বাড়ি কিনে নিয়েছিলো সাগরের এক প্রিয় বন্ধু সৈকতের বড়লোক বাবা।
সাগরই তাকে বলেছিল, “কাকু আপনি বাড়িটা এই মুহুর্তে কিনে
নিন, আমি ফিরে এসেই বাড়িটা কিনে নেবো” এবং তারপর সাগর ফিরে এসে বাড়িটা আগে কিনে নেয়। সাগরের বাবা মারা যান ওর
রাশিয়ায় থাকাকালীন, শেষ বেলায় বাবার কাছে সে থাকতে পারেনি,
সেই দুঃখ চিরকালীন থেকেই যাবে। সাগর কাকাকে চিঠি লিখে সবকিছু
ব্যবস্থা করতে বলেছিল। সেই অনুযায়ী ওর কাকাই বাড়িতে এই দুজনকে রাখার ব্যবস্থা করে।
সাগরের কাকা নারায়নবাবু বলেন,
- হ্যাঁ বৌমা, এরা আমার চেনাজানা। এই বাড়িতে এদের দেখাশনার জন্যই রাখা হয়েছে।
হরিকাকার এই বাড়িটা সাগরের বাড়ি। আমি আগলে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মাত্র।
- কাকাবাবু, আপনিতো আমাদের অভিভাবক। এইভাবে বলবেন না। আপনি যা ভালো বুঝেছেন তাই
করেছেন।
সাগর আবার বলতে শুরু করল...
হরিদাদু বাড়ি বিক্রি করার কথা যখন বলেছিলেন, তখন ওর বাবা দাদুর মেয়ে শিখাকে অনেক
খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওর বাবা মারা যাওয়ার পর সেই দায়িত্ব কাকা নেয়।
কাকা দাদুর ছোট মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিলেন, কিন্তু সে আর এই
পৃথিবীতে ছিলো না। শিখার বর একজন মদ্যপ ছিলো। ঠিক ভাবে দেখাশোনা করেনি। একদিন
শিখাকে খুন করে তারপর জেলে চলে যায়। তাদের একমাত্র মেয়ে চলে যায় কোন এক অনাথ
আশ্রমে। আশ্রমেই সেই মেয়েটি ছোট থেকে বড় হয়। অনাথ আশ্রমের গুরুমার তত্ত্বাবধানে
সেই মেয়ে ভালো পড়াশোনা করে এবং পরবর্তী কালে একটি স্কুলের দিদিমনি হয়। সাগরের কাকা
সব খোঁজ খবর নিয়ে সাগরকে জানিয়েছিলেন। এরপর সাগর ফিরে আসে কলকাতায়। কাকার কাছে
খোঁজ-খবর নিয়ে সেই মেয়েটির কাছে যায় এবং তাকে তার গৃহিনী হওয়ার প্রস্তাব দেয়।
কাকাই সবকিছু দেখাশোনা করে বিয়ে দেন। এরপর সাগর রমাকে বলে - হ্যাঁ রমা তুমিই হলে
হরিদাদুর একমাত্র নাতনী। আজ তোমাকে তোমার দাদুর বাড়ি ফিরিয়ে দিলাম।
রমার চোখ দিয়ে অশ্রুরাশি ঝড়ে পড়ছে। সে বিহ্বল হয়ে
পড়লো। কি বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না। সে সাগরকে
- তুমি আমার সাথে কথা বলবে না।
এতকিছু তুমি আমাকে বলোনি কেন? আমি আমার দাদুকে দেখতেও
পেলাম না।
নারায়ণবাবু বলেন,
- কাঁদেনা বৌমা, তোমাকে বলার সুযোগ ছিলো নাতো। কি করে বলবো বল। আজকের এই খুশির দিনে
চোখের জল ফেলতে নেই মা।
শিবেশ ও উমাপতি প্রায় একসাথে বললো,
- বৌদি, ভেবে
দেখুন, আপনাকে বলে দিলে এই চমকটা হতো কি, যা হয়েছে দারুন একটা ব্যাপার হয়েছে। সাগর যে ফিরে এসে আমাদের সব্বাই কে
এইভাবে চমক দেবে ভাবতে পারিনি। ও শুধু বড় ডাক্তারই নয়, খুব
বড় মনের মানুষ। বৌদি, আপনি রাগ করবেন না, আজকের এই খুশির দিনে আমরা সব্বাই একসাথে আনন্দ করবো।
সাগর বলল,
- নিশ্চয়ই আনন্দ করবো। তার আগে আমি
রমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। প্লিজ রমা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। একটা অনুরোধ করব
তোমাকে, যদি এই বাড়িটার পাশে পুরো বাগানটায় হরিদাদুর নামে
একটা হাসপাতাল করি, খুব কি খারাপ হবে। তুমি এখন মালিক,
তোমার অনুমতি ছাড়া তো এগোনো যেতে পারে না। এখানকার গ্রামের
মানুষের অনেক উপকার হবে, কেউ চিকিৎসার জন্য আর শহরে যাবে
না।
- এইরকম বললে আমি আর কথা বলবোই না।
আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি, আমি মালিকত্ব চাই না। আমার
খুব ভালো লাগছে আমি অজান্তেই শিকড়ের টানে নিজের জায়গায় চলে এসেছি। এখানকার ভালো
কিছু হলে আমারও খুব ভালো লাগবে। আর শোনো ডাক্তারবাবু, শুধু
হাসপাতাল করাই নয়, প্রতি সপ্তাহের একটা দিন তুমি এই
গ্রামের মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবে, কথা দাও। তোমার
সাথে আমিও আসব।
- সে আর বলতে
সবাই সাগর আর রমার কথায় হো হো করে হেসে ফেললো। এরপর
তারা ফিরে গেলো নিজেদের বাড়িতে, এবং কালীপুজোর তোরজোড় আরম্ভ করে দিলো। রাত ১১টায় যাথারীতি ব্রাহ্মণ
মশাই এসে পুজো আরম্ভ করলেন। সাগর আর রমা দুজনেই অঙ্গীকারবদ্ধ হল আগামী দিনগুলোয়
হরিদাদুর স্মৃতিগুলো তাদের কাজের মাধ্যমে যেন আরো বিকশিত হয়ে ওঠে।
প্রকাশিত (মুদ্রিত)- আমাদের লেখা
পত্রিকা, ২০১৯
ছবিঃ রেওয়া পত্রিকার, বিপন্ন শৈশব সংখ্যার প্রচ্ছদ থেকে আংশিক নেওয়া