Monday, November 26, 2018

কবিতা - দাদার কবিতা


রাজকুমার ঘোষ -

আমার দাদা দারুণ রাগী…
ব্যস্ত ভীষণ কাজে ।
অবসরে কবিতা লেখেন,
বকেনা আজে বাজে ।

দাদা ভীষণ ধর্মভীরু,
ঠাকুর-দেবতা মানেন ।
তারই প্রভাব কবিতা মাঝে …
প্রায়ই টেনে আনেন ।

আমার দাদা অতি কট্টর
প্রেমের পূজারী নন ।
কাম্ নিয়ে তবুও লেখেন
প্রেমকে বিসর্জন ।

প্রথম দিকে দাদার লেখার…
আমি ছিলাম আসক্ত ।
দাদা এখন নামী কবি,
কিন্তু, কবিতা বোঝা শক্ত ।


রামধনু সাহিত্য পত্রিকা, বাঁকুড়া, ২০১৩ সাল 

Sunday, November 18, 2018

গল্প - সাইকেল


রাজকুমার ঘোষ -

- এই তোর ঢড়ঢড়ে মার্কা সাইকেলটা সরাতো... আমাদের টু-হুইলারের কাছে বড়ই বেমানান
- তোর বাপের তো অনেক পয়সা... চাইলেই তো স্টাইলিশ হতে পারিস, একটা বাইক কিনে নিজের হুলিয়াটা পালটা...!!
বন্ধুদের থেকে এইরকম প্যাঁক প্রায় সময় শুনতে হয় রোহনকে। কিন্তু রোহন এই সাইকেল নিয়েই সর্বত্র ঘুড়ে বেড়ায়। বাড়ি থেকে যেকোনো দোকানে যাওয়া, বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া, বিভিন্ন কোচিং-এ যাওয়া, খেলার মাঠে যাওয়া এমনকি যারা প্যাঁক দেয় সেই বন্ধুদের আড্ডাখানাতেও সে সাইকেল নিয়ে যায়। রোহন এখন কলেজের ফার্স্ট-ইয়ার স্টুডেন্ট, সে কলেজেও যায় এই সাইকেল নিয়ে, ওর বাড়ি থেকে কলেজ যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক তো লাগেই... কলেজে ওর সহপাঠীরা যেখানে হাই-ফাই বাইকে মেয়েদের পেছনে বসিয়ে কলেজে যায়, সেখানে ওর এই মার্কামারা সাইকেল নিয়ে কলেজ যাওয়াটা সকলের হাসির উদ্রেক তৈরী করে। ওর তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
আসলে এই সাইকেল ওর প্রাণের থেকেও প্রিয়, ওর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ও যখন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠলো তখন ওর দাদু কিনে দিয়েছিল। দাদু ওর ভীষণ প্রিয়। যাবতীয় আবদার ওর দাদুই পূরণ করত। সেই দাদুই মাধ্যমিক পাস করার পর বাইকও কিনে দেবে বলেছিল, কিন্তু বাদ সাধে ওর বাবা। বাইক কেনা আর হলো না। দাদুও সেই বছর মারা গেল, তারপর থেকে ও একাই হয়ে যায় বলা যেতে পারে, দাদুর স্মৃতি বিজরিত এই সাইকেলটাই ওর সম্বল। ও সাইকেলটা কোনরকম কাছছাড়া করে না।
ক্লাস টুয়েল্ভ্‌ পড়ার সময় রিনার সাথে পরিচয় হয়েছিল, যার সাথে ওর নিবিড় বন্ধুত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। ওকে রোহন খুবই ভালোবাসে। পড়াশোনার ব্যাপারে দুজনের বোঝাপড়া ভীষন ভালো। একে ওপরের উপর নির্ভরশীল। একই সাথে কোচিং-এ যাওয়া বা মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া সবই হতো। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে ওদের বন্ধুদের মধ্যে জোর আলোচনাও হতো। কিন্তু মুখ ফুটে রোহন রিনাকে ভালোবাসার কথা বলতে পারেনি, হঠাৎ করে একদিন রোহন রিনার বাড়ির ছাদের ঘরে ওর হাত ধরে বলেছিল, ‘রিনা, তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তুইও কি আমাকে...’ রিনা থামিয়ে দিয়ে, ‘আমি আপাতত এই নিয়ে ভাবিনি রে, চল অরগানিক কেমিস্ট্রির সাজেশন নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক’... রোহন রিনার মুখে এক ঝিলিক হাসি লক্ষ্য করেছিল সেদিন... কিন্তু রিনা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। এরপর রোহন আরও অনেকবার প্রোপোস করেছিল, রিনার তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ সেভাবে পায়নি... রিনা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল।
ওরা সুবিরবাবুর কোচিংয়ে একসাথে অঙ্ক করতে যেতো। রোহন সাইকেল নিয়ে সেখানে পড়তে যেতো। রিনাকে ওর বাবা বা মা দিয়ে আসতো। মাঝে মাঝে রিনা একাও আসতো, বাড়ি যাবার সময় রাত ৮টা বেজে যেতো সেক্ষেত্রে রিনা কোনো ছেলেবন্ধুর বাইকে করে চলে আসতো। রোহন রিনাকে বলত, ‘আজ তোকে সাইকেল করে পৌছে দেব’। রিনা একপ্রকার তাচ্ছিল্য করে ‘তোর ঐ ওল্ডমার্কা ঢড়ঢড়ে সাইকেলে আমি চড়বো না, প্লিজ আমাকে বলিস না এভাবে’... রোহন নির্বিকার হয়ে থাকতো আর মুচকি হাসতো। ও হতাশাও প্রকাশ করেনি কোনোদিন।
ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়ও ওরা সুবিরবাবুর অঙ্ক ক্লাসে আসতো। রোহনের বারবার প্রোপোসেও রিনা বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি এবং বিরক্তও দেখায়নি। রিনাও তো রোহনকে ভালোভাবে চেনে বা বোঝে। দুজনের মধ্যে কথা, খুনসুটির সব কিছুর সাক্ষি এই সাইকেল। রিনাও এই সাইকেল নিয়ে অনেকবার খোঁটা দিয়েছে, ওকে বলেওছে যে একটা বাইক কিনতে এবং সেই বাইকেই ও চড়বে বলে জানিয়েছে। কিন্তু রোহন এই সাইকেলের সাথে দাদুর স্মৃতির ব্যাপারে রিনাকে কোনোদিনই কিছু বলেনি। রিনাকে বললে হয়তো বুঝে যেতো।
একদিন রোহনের জ্বর হয়েছে সেই অবস্থায় সুবিরবাবুর কোচিং-এ গেছে... সেদিন ও আর রিনা ছাড়া আর কেউ ক্লাসে আসেনি। রিনাও সেদিন একা এসেছিল তারপর ক্লাসের শেষে রাত ৮টার সময় একা একাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, কোচিং থেকে বাড়িতে যেতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাগে। রাতের পর রাস্তাও প্রায় অন্ধকার। মেয়েদের পক্ষে একা বাড়ি যাওয়াও যথেষ্ট নিরাপদ নয়। রোহন তাই বলল, ‘কিরে অন্তত আজ আমার এই সাইকেলে বসে চল’... রিনা আপত্তি জানালো না। সে সাইকেলের ফ্রন্ট স্ট্যান্ডে উঠে পড়লো। রোহন রিনাকে সাইকেলে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলো। রিনার শরীর রোহনের শরীরে স্পর্শ করলো। প্রায় প্রথম স্পর্শে রোহন কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ল। ইচ্ছা হলো রিনার উন্মুক্ত পিঠে একটা ঠোঁটের ছোঁয়া দেবার, কিন্তু ও আড়ষ্ট হয়ে সাইকেল চালাতে লাগলো। রিনা ওকে যেন ভুল না বোঝে। কিন্তু ওর ধারনা ভুল প্রমাণ করে রিনা ওর বুকের ওপর মাথাটা রাখতেই রোহন জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে কিছু বলবি’
- তুই তো বলিস, বলেই ফেল আবার
- আমার আর বলার কি আছে, গত দু’বছর ধরে একই কথা বলতে বলতে তোর কান পচে গেছে। ছাড়... আর সাহস হয় না... তুইতো আমার ভালোবাসা বুঝতেই পারিস না।
- তুই যেন খুব বুঝিস, মাথামোটার মত কথা বলিস না। সব কথাই কি মুখেই বলতে হয় রে। আমার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিস কোনদিন...
- না... কি হবে তাকিয়ে... তুই কতবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিস, চোখের দিকে তাকাতে সাহস হয় না।
- তুই তো আহাম্মক, বোঝার ক্ষমতা তোর তো একদমই নেই...
- ঠিক আছে, আমি অবুঝ... বেশি কথা বাড়িয়ে কি হবে, আমার শরীর ভালো নেই, জ্বর হয়েছে, তোকে বাড়ি পৌছে দিয়েই বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। বুঝতে পারছিস না, বুকের ওপর মাথাটা দিয়ে আছিস...
- তোর এই গরম বুকেই আমার আস্তানা রে... তুই না এক্কেবারে বোকা... আমার অবুঝ লাভার তুই... খুশি তো... এবার তোর ইচ্ছাটা পুরণ করতে পারিস...
- কি ইচ্ছা ?
- এই যে এতক্ষণ ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে যেটা তোর মনে হচ্ছিল। ভীতুর ডিম কোথাকার...
রোহন বুঝতে পারে। কিন্তু কিভাবে রিনা বুঝতে পারল ওর মনের গোপন ইচ্ছা। যাই হোক ও জিজ্ঞাসা করলো না। রিনার পিঠে আলতো করে ঠোঁটের ছোঁয়ায় বুঝিয়ে দিল। নিজেকে এখন বেশ হিন্দি সিনেমার হীরো মনে হতে লাগল। শরীর থেকে গরম আভাস কোথা থেকে উবে গেল। মাথার ব্যাথাও কমে গেল। নতুন উদ্যমে ও সাইকেল নিয়ে রিনার বাড়ির কাছাকাছি চলে এল। রিনার বাড়ির দরজার কিছু আগে একটু অন্ধকার। ও সাইকেল রেখে রিনার হাত ধরে দরজার পাশে একটি দেওয়ালের কাছে চলে এল, যেখান থেকে ওদের আর কেউ দেখতে না পায়। রিনা ওকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে সোহাগী ভালোবাসায় মেতে উঠল। রোহনও নিজেকে মুক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে দিল, ‘রিনা আমি তোকে খুব ভালোবাসিরে’
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাইকেলের হেডলাইটটা মনে হল একবার জ্বলে উঠলো। হয়তো রোহনের দাদু সাইকেলের মধ্যে নিজের উপস্থিতি জানান দিল যে, “অবশেষে আমার নাতি একটা নাতবৌ পেলো”।
 
প্রকাশিত - পদক্ষেপ পত্রিকা, চুঁচুড়া - ২০১৭ বইমেলা সংখ্যা 

Monday, November 5, 2018

অণুগল্প - মডার্ণ শিব

রাজকুমার ঘোষ - 


সাধ করে দাদু নাতনীর নাম রেখেছিলেনইশানী’, কিন্তু মডার্ণ যুগের বন্ধুদের পাল্লায় পরে নামটা ইশুতে এসে ঠেকেছেইশু হলো রক্ষণশীল বনেদী পরিবারের মেয়ে । ইশুর মা বেশ ধার্মিক মহিলা, তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর সবাই ওনার আরাধ্য ইশুকেও তিনি নিজের মতো করে ঠাকুর দেবতাদের একনিষ্ঠ ভক্ত করে তুলেছিলেন । ঈষুর অটল বিশ্বাস যে, মন দিয়ে শিবের পূজা করলেই শিবঠাকুরের মত বর পাওয়া যাবে । এ নিয়ে ওর বান্ধবীরা খুব ঠাট্টা-তামাশাও করতো । সুন্দরী ইশুর ওপর অনেক ছেলের দৃষ্টি থাকলেও ইশুর চোখে মডার্ণ শিবঠাকুর ছিল ওদের কলেজের বিক্রম, ওরফে ভিকি । ভিকি কলেজে আসে চার-চাকার গাড়ি নিয়ে । অন্যান্য বান্ধবীদের মতো ইশুও ঐ ভিকির প্রেমে পাগল ছিল । সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, বিমল ইশুকে খুব ভালোবাসতো । বিমল ওদের পাড়াতেই থাকে, পড়াশোনায় ভালো । নিজের যোগ্যতায় সে একটা ভালো চাকরীও করছে । বিমল ইশুকে তার মনের কথা জানিয়েছিল, কিন্তু ইশু জবাবে একটা জোরালো থাপ্পর মেরেছিল । বিমল খুব আঘাত পেলেও ইশুকে মন থেকে সরাতে পারেনি । ওদিকে নিষ্ঠাভরে শিবের সাধনা করে ইশু নিশ্চিত ছিল যে ভিকিকে সে তার বর হিসাবে পাবেই । তাই ওরা খুব ঘনিষ্ট ভাবে মেলামেশা শুরু করে দিয়েছিলো । ভিকি খুব সহজেই ইশুর শরীরটা অধিকার করে নিয়েছিল,কিন্তু ইশুকে বিয়ে করতে চায় নি, সেরকম কোন ইচ্ছাই ওর ছিল না । ইশুর বাবা-মা মেয়ের মুখ চেয়ে ওদের বিয়ের জন্য ভিকির বাড়িতে গিয়েছিলেন, কিন্তু ভিকির পরিবারের কেউই নূন্যতম সম্মানটুকুও দেয়নি, কথা বলা তো দূর অস্ত । এরপর নানা ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে ইশুর বিয়ে ঠিক হল, আর, বিয়ের দিনেই ইশু জানতে পারলো তার হবু বর হলো সেই বিমল, যাকে ও অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল । আর বুঝতে পারল বিমল হল সেই নীলকণ্ঠ যে ওর সমস্ত কিছু জেনেও, ভালোবেসে ওকে আপন করে নিচ্ছে ওর শিবপূজো এতদিনে তবে সার্থক হল ! ..

প্রকাশিত - প্রেরণা সাহিত্য পরিবার, ২০১৫ 

Friday, November 2, 2018

বড়গল্প - নিশা



রাজকুমার ঘোষ -
(১)
ছোট্ট নিশাকে রসুল, কাদের, জামালরা কিডন্যাপ করে । গুলমার্গের বরফে আবৃত প্রাকৃতিক শোভায় বিভোর হয়ে নিশার পাপ্পা-মাম্মি আত্মহারা । বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তুলোর মতো ছড়িয়ে থাকা বরফের কণা, তার ওপর রোদ্দুরের মিষ্টি রশ্মি, ছোট বড় চিনার গাছে বরফের চাদর সব মিলিয়ে ওরা মোহিত হয়েছিল ।
- বাপুজি আপকা বেটি কাহা হে – গাইডের জিজ্ঞাসাতে ওদের হুঁশ আসে । এইতো নিশা ছিল ওর পাপ্পার হাত ধরে, কোথায় গেল ? খেয়ালই নেই যে তাদের একমাত্র ফুটফুটে মেয়েটাকে রসুলরা মুহুর্তের বিভোরতায় তুলে নিয়ে গেছে । সমস্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মোহ তৎক্ষনাৎ তলানিতে চলে গিয়ে ওরা যত্র-তত্র ছোটাছুটি, খোঁজাখুঁজি করতে লাগল ।
(২)
এদিকে নিশাকে নিয়ে রসুলদের উদ্দেশ্য বেশ ভয়ঙ্কর, ওকে নিয়ে বর্ডারের কাছে গেলেই বেশ চড়া দাম পাবে। তবে কাঁটাতারে আটকে থাকা মেন রাস্তার মূল গেট দিয়ে অবশ্যই নয়, কারণ ঐ রাস্তা দিয়ে গেলে হয় ভারতীয় সেনা না হয় পাশের দেশের সেনাদের হাতে পড়ার বিপুল সম্ভাবনা। তাই মাটির তলা দিয়ে দুই দেশের বর্ডারের মাঝে একটা চোরা গুপ্ত রাস্তা আছে সেখান দিয়ে গেলেই ও পারে আছে আব্দুল যে নিশাদের মত কত মেয়েকে নিজেদের দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেছে তার ঠিক নেই। তবে এই আব্দুলের মত দালালের কাছে রসুলরা সরাসরি যাবে না। ওদের এই পাচার চক্রের ঘাঁটি হল অনন্তনাগে। আপাতত ওরা সেখানেই আসে। এই অনন্তনাগের ঘাঁটি থেকে ওরা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে। শুধুমাত্র নারী পাচারই নয়, বোমা তৈরী করা এবং নিজেদের জেহাদির জন্য বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা ছড়ানো সবই হয়। কিছুদিন আগেই ওদের জঙ্গি সংগঠন শ্রীনগরের মূল কেন্দ্রে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়, যার জেরে একজন মন্ত্রীসহ অনেক পুলিশ নিরীহ মানুষ নিহত হয়। মিলিটারিরা সবই খোঁজ খবর পেয়ে অনন্তনাগের এই ঘাঁটিতে আক্রমণ করতে আসে। মিলিটারির জওয়ানেরা ঐ ঘাঁটিটিকে ঘিরে ফেলে। রসুল, জামাল ও কাদের নিশাকে নিয়ে একটি সাফারি গাড়ি করে সেখান থেকে পালাবার চেষ্টা করে। জওয়ানরা ওদের পিছু নেয়। কিন্তু সাফারি নিয়ে ওরা বেশিদুর এগোতে পারেনি। চলন্ত গাড়ি থেকে রসুল নিশাকে নিয়ে নামবার চেষ্টা করে কিন্তু একটি লোহার রডে রসুলের পেট এফোঁড় হয়ে যায় আর নিশা কপালে চোট পেয়ে চৈতন্য হারিয়ে পড়ে থাকে মৃত রসুলের পাশে। সাফারি গাড়িটা জওয়ানদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য সোজা খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয়। জওয়ানরা একপ্রকার নিশাকে না দেখেই সেখান থেকে চলে যায়। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার মুখে এক কাশ্মিরী দম্পতি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল, তারা নিশাকে দেখতে পায়। মৃত রসুলের পাশে অচৈতন্য অবস্থায় ওকে দেখে ওরা বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নিশাকে ছুঁয়ে বুঝতে পারে নিশার প্রাণ আছে এবং কপাল ফেটে রক্ত বেরোনোয় ওরা তড়িঘড়ি নিশাকে নিয়ে চলে আসে ওখানে অবস্থিত একটি ক্লিনিকে... খানিকবাদেই নিশার জ্ঞান ফিরে আসে ।
“তু কোন হে বেটি, কাঁহাসে আয়া” – নিশা কিছুই বুঝতে পারে না । ওর এই তিন বৎসর বয়সে এই প্রথম পাপ্পা-মাম্মি ছাড়া... তাদেরকে দেখতে না পেয়ে ও ‘পাপ্পাআআআআআ ...... মাম্মিইইইইইইই’ বলে কাঁদতে থাকে। নিশা ঐ কাশ্মিরী দম্পতি ও ক্লিনিকের ডাক্তারকে দেখে আরো ভয় পেয়ে যায়। আর কিছুই না বলে পুনরায় অজ্ঞান হয়ে যায় ।
(৩)
নিশার পাপ্পা-মাম্মি তাদের একমাত্র আদরের মেয়েকে দেখতে না পেয়ে প্রায় পাগলের মত অবস্থা । গুলমার্গে ওরা বেশ ভালোই মনোরঞ্জন করছিল । ওরা ওখানকার ঘোড়াতে বসে গাইড নিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছিল । নিশার পাপ্পা প্রায় সময় ওকে নিয়েই ছিল। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে কি যে হয়ে গেল। মেয়েকে দেখতে না পেয়ে ওরা গুলমার্গের লোকাল থানায় যায়। ওরা কিছুই সাহায্য করেনি। সেখান থেকে মিলিটারি ক্যাম্পের জওয়ানদের কাছে যায়। ক্যাম্পের প্রধান মেজরের সাথে কথা বলে ওরা গুলমার্গ থেকে শ্রীনগরে ফিরে আসে। শ্রীনগরে ফিরে এসে ওরা পুলিশ কমিশনারের অফিসে যোগাযোগ করে সব কিছু জানায়। এরপর ওরা মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করে। কেউ ওদের আশ্বস্ত করে, আবার কেউ কেউ আশংকা প্রকাশ করে, এই দুইয়ে মিলে এক ধোঁয়াশা পরিস্থিতিতে প্রায় পাঁচদিন শ্রীনগরে কাটিয়ে দিল কিন্তু তাদের একমাত্র মেয়ের কোনো খবরই পেলো না। পুলিশ কমিশনার ওদের বাসস্থান দিল্লীতে ফিরে যেতে বলে এবং আশ্বস্ত করে যেকোনো খবর পেলেই ওদেরকে জানানো হবে এবং প্রতিদিনই ফোন করে জানাবে। ওরাও নিরুপায় হয়ে দিল্লীতে ফিরে আসে ।
(৪)
সুখবীর যাদব বিহারের ছাপড়াতে বাড়ি। ওদের এলাকায় সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র সুখবীর কর্মসূত্রে দিল্লীতে চলে আসে। প্রায় আট বছর দিল্লীর একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করে বেশ ভালো জায়গায় চলে এসেছে। সে কোম্পানীর জোনাল ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্বে আছে। পাঁচ বছর আগে বিয়ে করে রোহিনীকে ... তারপর বছর দুই পরে ওদের কোল আলো করে আসে ওদের একমাত্র আদরের দুলালী নিশা। কোম্পানী থেকে সুখবীরকে সবরকম সুবিধা দিয়েছে। ফ্ল্যাট, গাড়ি সবই... কোম্পানীই ওদেরকে কাশ্মীর ঘোরার সবকিছু ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
কিন্তু গুলমার্গে নিশা নিখোঁজ হয়ে যেতেই ওদের সমস্ত আয়োজন পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। কার্যত হতাশ হয়ে ফিরে আসে দিল্লীতে। ওরা যে আবাসনে থাকে সেই আবাসনের সকলের প্রিয় ছিল নিশা। নিশার নিখোঁজে সকলেই বাকরুদ্ধ । সুখবীর দিল্লী ফিরে এসে কোম্পানীকে এবং দিল্লী পুলিশের ওপর মহল তথা মন্ত্রী লেবেল পর্যন্ত সকলকে জানায় । কিন্তু দশ দিন হয়ে যাওয়ার পরও কোনো ভালো খবর পায়নি। নিশার মা রোহিনী মেয়ের শোকে অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়।
(৫)
রহমান আলি তার বিবিকে নিয়ে অনন্তনাগে তার বড় ছেলের বাড়ি যাচ্ছিল । সেইদিন সন্ধ্যের সময় যাবার পথে নিশাকে রাস্তায় একটি লাশের পাশে পড়ে থাকতে দেখে । নিশাকে তারা ওখান থেকে নিয়ে একটি ক্লিনিকে যায়, ডাক্তার চিকিৎসা করে ওদের ছেড়ে দেয় । পরেরদিনই ওনারা নিশাকে নিয়ে শ্রীনগরে ওদের বসতবাড়ি ডাল লেকে ফিরে আসে । নিশার থেকে ওর বাড়ির ঠিকানা জানতে চায় কিন্তু কদিনের ঘটনায় নিশা একেবারে দিশাহারা, কিছুই বলতে পারে না । তিন বৎসরের নিশা বেশ আতংকে ভুগছে আর পাপ্পা-মাম্মির জন্য কাঁদছে । রাতে ঘুমের ঘোরে ‘পাপ্পা’ আর ‘মাম্মি’ বলে চিৎকার করছে । রহমান আলির বাড়িতে অনেক ছোট ছোট নাতি ও নাতনি আছে, তাদের সাথেও কথা বলছে না । এইভাবে প্রায় দশ-বারোদিন পেরিয়ে যায় কিন্তু নিশার থেকে কোন ঠিকানাই ওরা পায় না। আস্তে আস্তে নিশা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, খেলার সঙ্গী হিসাবে পেয়ে যায় রহমত আলির নাতি-নাতনিদের, কিন্তু ভাষাগত সমস্যার জন্য ও কাউকে ওর মনের কথা বলতে পারে না। রহমত আলি এবং ওর পরিবারের কাছে নিশা পরম স্নেহে থাকে । একদিন নিশা ওদের মোবাইলে কথা বলতে দেখে আনন্দের সাথে কতগুলো নাম্বার মুখে উচ্চারণ করে। ওরা সাথে সাথেই ওকে জিজ্ঞাসা করে ‘বেটি, ইয়ে কিসকা নাম্বার?’ নিশা অতি কষ্টে ওদের বোঝাতে পারে যে নাম্বারটি ওর পাপ্পার ।
(৬)
সুখবীর যাদব তার মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে যদি কোন ফোন কাশ্মীর থেকে আসে । এদিকে রোহিনী অসুস্থ । তাদের একমাত্র মেয়ের জন্য শোকে কাতর । একদিন হঠাৎ একটা ফোন আসে কাশ্মীর পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে । জানতে পারে একটি বাচ্চা মেয়ে এক পরিবারের কাছে আছে কিন্তু তারা মেয়েটির নাম জানতে পারেনি । ওরা মেয়েটির মুখ থেকে নাম্বারটা জানা মাত্রই ফোন করে। নিশার মা রোহিনী মেয়েকে তার পাপ্পার নাম্বারটা কোন এক সময়ে মুখস্থ করিয়েছিল। যার সুফল তারা পেয়েছে অতএব একরাশ আশায় বুক বেঁধে সুখবীর কাশ্মীর পুলিশ কমিশনারের অফিসে ফোন করে এবং বিস্তারিত খোঁজখবর নেয় তারপর রোহিনীকে নিয়ে আবার কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে।
(৭)
কাশ্মীরের পুলিশ রহমত আলির বাড়িতে আসে । তারা এই কদিনে অসাধ্য সাধন করেছে যার জন্য খোদ পুলিশের বড় কর্তাই তাদের বাড়িতে এসেই নিশাকে দেখতে চায়। সুখবীরের কাছে পাওয়া ছবির সাথে নিশার মিল দেখে সকলেই আশ্বস্ত হয়। নিশার পাপ্পা ও মাম্মি কাশ্মীরে পৌছে যায় । তারা তাদের মেয়ের খোঁজে ডাল লেকের রহমত আলির বাড়িতে আসে । সুখবীর ও রোহিনীকে রহমত আলির পরিবার আন্তরিক ভাবে স্বাগত জানায় । মেয়েকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে তারা রহমত আলীর পরিবারকে কিছু উপহার দিতে চায়। কিন্তু ওদের পরিবার তা নিতে অস্বীকার করে । নিশাকে তাদের ‘গুড়িয়া বেটি’ সম্বোধন করে । কদিনে ওর প্রতি মায়াও পড়ে যায় । তারা কদিনের জন্য নিশা ও নিশার পাপ্পা-মাম্মিকে ওদের কাছে থাকার জন্য অনুরোধ করে । এরপর সুখবীর, রোহিনী এবং ওদের ‘গুড়িয়া’ নিশা মেহমান হিসাবে প্রায় সপ্তাহখানেক থাকে । ডাল লেকের সৌন্দর্য্য এবং হাউস বোটে কাটানোর স্বর্গীয় সুখ অনুভব করে । এছাড়াও শ্রীনগরের বিভিন্ন গার্ডেন ‘চশমিশ সাহি’, ‘মুগল গার্ডেন’, ‘শালিমার গার্ডেন’ সহ শঙ্করাচার্্যে র মন্দির সবই প্রদর্শণ করে।
অবশেষে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাকে দুঃস্বপ্ন হিসাবে ভুলে গিয়ে, রহমত আলির পরিবারের সৌজন্যে কাশ্মীরকে আরো সুন্দর ভাবে চিনে ওরা দিল্লীতে ফিরে আসে ।
 
প্রকাশিত - পদক্ষেপ পত্রিকা, চুঁচুড়া, রথযাত্রা সংখ্যা, ২০১৭ 

Monday, October 29, 2018

কবিতা - রঙ্গমঞ্চ

রাজকুমার ঘোষ -

জানিনা এর শেষ কোথায় ?
অশান্ত এই মন কি যেন চায়...!
তার চাওয়া-পাওয়ার পরিধীটা,
সে অনুমান করেছে,
কিন্তু নির্ধারণ করতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে গেছে !
তবে কি এ’ ভাবেই ......

মঞ্চে তামাশা দেখাবার লোকের ভীড়
অচেনাএকজন এসে মিষ্টি সুরে বলল, ‘আমি তো আছি ?’
পরক্ষণেই,
আর একজন এসে তার হাতে অনেক কিছু দিয়ে বলল, ‘খেটে খা ...’

বড়ই বিচিত্র এই রঙ্গমঞ্চ !
জানিনা এই রঙ্গে কি হবে মোহভঙ্গ ?
নাকি সবার অলক্ষ্যে থাকা,
না জানা কোনো শুরুর সঙ্গ ... !


প্রকাশিত - মোরামের সাহিত্য পত্রিকা, ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ 

Saturday, October 13, 2018

কবিতা - মায়ের পুজো


রাজকুমার ঘোষ-

বছর ঘুরে এলো আবার
খুশির মহোৎসব
মহালয়ার মিষ্টি সুরে
আগমনির কলরব... 

পাড়ায় পাড়ায় মঞ্চ গড়ে  
মাতৃপুজোর ধুম  
প্রতিযোগিতায় টেক্কা দিতে
চলেই গেছে ঘুম ।

মা থাকেন বৃদ্ধাশ্রমে
নেইকো কোন খোঁজ...  
লোকদেখানি পুজোর মাঝে
চলছে মহাভোজ  

পুজোর এই চারদিনে  
উতলে ওঠে মন,  
পাওনা গণ্ডার আরাধনায়
মত্ত জনগণ ...!

ভক্তিভরে মাকে জানায়
শুধুই দিয়ে যাও...  
সমাজ সংসার রসাতলে
খেয়াল নেই তাও !

নগ্ন করে মাকে পেটায়,
এইতো মায়ের পূজা 
চেতনা তুমি কবে দেবে,
ওগো মা দশভূজা ... ?     

প্রকাশিত - কবিতা ক্লাব 

Sunday, October 7, 2018

কবিতা - সাথী হারা

রাজকুমার ঘোষ -

বন্ধু,
শৈশবে তোর খেলার সাথী...
খেলেছি অনেক খেলা, ঘুরেছি কত মেলা
অনেক ‘না খেলা’ জিনিসেও মন মাতাল হয়ে খেলেছি...
বড়রা দিতো বাধা, রাগও হত তাদের ওপর...
তোকে অন্ধের মত সমর্থনে তারাও অখুশী হয়েছে, তাও দেখেছি !!

কৈশোরে অনেক ‘না দেখা’ জিনিসের সাথী...
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোকে সমর্থন করেছি...
অনেক ‘না ভাবা’র মাঝেও তোকে নিয়ে ভেবেছি...

কিন্তু আজ,
চেতনাকে জাগিয়েছি...
অস্তিত্ত্বকে খুঁজে পেয়েছি ।
ভাবলাম বয়সের ভারে তুইও নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিস...
কিন্তু, তিন ‘ম’ এর নেশায়, তুই হলি বাঁধন ছাড়া ।
বন্ধু, আমি যে হয়ে গেলাম সাথী হারা !!

Saturday, October 6, 2018

কবিতা - তুই এবং তুমি ?

রাজকুমার ঘোষ -

ভাই রে... তুই নাকি ছবি তুলিস ?
আকাশের ছবি ?
তোর ছবির নীলিমাতে অসংখ্য ছোপ ছোপ আঁকিবুকি ।
খেয়াল করিসনি বোধ হয়... !
‘না’-এ আবৃত মন দিয়ে বিরাটকে চিনবি কেমন করে ?
ভাইরে একটু মাটিতে তাকা...
দেখবি কি যেন একটা বোধ আসবে... বিবেকের বোধ !
তারপর না হয়
নীলিমায় ভেসে যাস... । 

হে বন্ধু, তুমি নাকি কবিতা লেখ ?
সত্য ও সচেতনতার কবিতা ?
ভাষার কাঠিন্য আছে, কিন্তু কি যেন আলগা লাগে ।
ওহে, সকলের সাথেই না হয় নিজের ঢাকটা পেটাও
দেখবে তার মজাই আলাদা... ।
কোথায় ছড়িয়ে পড়বে আমি থেকে আমাদের মিলিত বিজয়যাত্রা...
তখন দেখবে, তোমার আমিও উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে ।


প্রকাশিত - পদক্ষেপ পত্রিকা, আধুনিক কবিতা সংখ্যা, ২০১৫ 

Friday, October 5, 2018

মুক্ত গদ্য - চেনা জগৎ

রাজকুমার ঘোষ - 

কোন এক ধনা মাস্টারের ইচ্ছায় সেই সময় ছেলেটির বাবা দুবার ভাবেন নি যে, তার ক্লাস ফাইভে পড়া আপাত নিরীহ ছেলেটির হোস্টেলে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি নেই ! ধনা মাস্টার বলেছেন তাই রাজী, কারণ হোস্টেলে গিয়ে ছেলেটি ঠিকভাবে গড়ে উঠবে, একজন মানুষের মতো মানুষ তৈরী হবে । বাবা কিন্তু বুঝল না ছেলেটি তার মা’কে ছেড়ে থাকবে কি ক রে ? মা কাঁদো কাঁদো মুখে তার স্বামীর সাথে ছেলেটিকে হোস্টেলে রেখে এল । ছেলেটি প্রচন্ড কষ্ট আর হতাশা নিয়ে একটা বিরাট অচেনা অজানা পরিবেশে চলে এল, সেখানে গিয়ে দেখল ওরই মতো আরো অনেক ছেলে আছে, আর আছে হিটলার রুপী ধনা মাস্টার, যার মধ্যে ছেলেটি তার স্বপ্নের দৈত্য-দানবদের ছায়া দেখতে পেতো । ছেলেটি বুঝে উঠতে পারে না সে কি করবে ?... তার চেনা জগৎ যে, তার মা… যাকে ছাড়া সে একটু ও ভাবতে পারে না । হোস্টেলের বদ্ধ জীবনে প্রথম দিন কেটে গেল… দেখতে দেখতে আরো এক মাস কেটে গেল । তখন মোবাইল দুরের কথা মা এর সাথে কথা বলার জন্য টেলিফোনও ছিল না । কিছু পোস্ট কার্ড এর ওপর ভরসা করে থাকতে হতো ।
সুখ তো নেই, খুব দুঃখের সাথে এক মাস কেটে যাওয়ার পর কোন একটা দিন ছেলেটি পুকুর পাড়ে আনমনা হয়ে বসে তার একমাত্র চেনা জগৎ, মা’এর কথা ভাবছে, দূরের মেন রোডে দেখল খুবই চেনা হাঁটার ছন্দে দু’জন আসছে । বুঝতে তার আর বাকি রইল না, সে তখনই পুকুর পাড় থেকে উঠে সরু রাস্তা ধরে এক দৌড়ে মেন রাস্তায় পৌছে গেল তার কাঙ্খিত চেনা জগৎ-এর কাছে । পৌছে গিয়ে সে তার মায়ের বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল, আর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল ।
এই ঘটনার ২০ বৎসর কেটে গেছে… আজ সেই ছেলেটি বহু ঘাত-প্রতিঘাতে বেড়ে ওঠা একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক । আজ মাতৃদিবসে সেই ছেলেটি ঐ ঘটনার কথা ভাবছে আর আজকেও সে হাউ হাউ করে কাঁদছে । কেন জানি না, কিন্তু সে কেঁদে যাচ্ছে, এই ছোট লেখাটা লিখতে লিখতে সে কেঁদেই যাচ্ছে । সে তার মা’কে কারণে অকারণে কত কিছু না বলেছে, মা তার কথায় খুব কেঁদেছে হয়তো । কিন্তু মা রাগ করেনি একটুও । হাসি মুখে সব কিছু ভুলে গিয়েছে । সেই ছেলেটি প্রতিদিন কাজ সেরে রাত করে বাড়ি আসে, কিন্তু খাবারের থালা নিয়ে আগলে বসে থাকে তার সেই ছোট বেলাকার একমাত্র চেনা জগৎ, তার মা । সেই ছেলেটি তার মাকে এখনও সেই চেনা জগৎই মনে করে । তার মাকে কখনই অচেনা জগৎ-এর সাথে মিলিয়ে ফেলে না । তার মাকে সে এখনও কাছ ছাড়া করতে চায় না ।
একটা ছোট লেখার মাধ্যমে মা-ছেলের যে অমোঘ টান, সেটা ব্যক্ত করা বেশ কষ্টকর । তবুও আজ মাতৃদিবসে আমার লেখার তরফ থেকে এটা একটা ছোট নিবেদন । আমার আজকের এই লেখাটা মান অনুসারে কত ভালো হলো বা কতটা লিখলে আরো ভালো হতে পারতো বা কতটা খারাপ হলো, সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই । প্রচন্ড জ্বর নিয়ে আজ এই লেখাটা লিখেছি । আজ মাতৃদিবসের দিন পাঠক বন্ধুদের ভালোবাসায় আমার এই প্রচেষ্টা । শেষে প্রত্যেককে বিশেষ করে মা’দেরকে জানাই শুভ মাতৃদিবস । আপনারা সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন আর সন্তানদের আগলে রাখুন । 

প্রকাশিত - রামধনু সাহিত্য পত্রিকা, বাঁকুড়া, ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০১৩