রাজকুমার ঘোষ -
- এই তোর ঢড়ঢড়ে মার্কা সাইকেলটা সরাতো... আমাদের টু-হুইলারের কাছে বড়ই বেমানান
- তোর বাপের তো অনেক পয়সা... চাইলেই তো স্টাইলিশ হতে পারিস, একটা বাইক কিনে নিজের হুলিয়াটা পালটা...!!
বন্ধুদের থেকে এইরকম প্যাঁক প্রায় সময় শুনতে হয় রোহনকে। কিন্তু রোহন এই
সাইকেল নিয়েই সর্বত্র ঘুড়ে বেড়ায়। বাড়ি থেকে যেকোনো দোকানে যাওয়া, বন্ধুদের
বাড়ি যাওয়া, বিভিন্ন কোচিং-এ যাওয়া, খেলার মাঠে যাওয়া এমনকি যারা প্যাঁক
দেয় সেই বন্ধুদের আড্ডাখানাতেও সে সাইকেল নিয়ে যায়। রোহন এখন কলেজের
ফার্স্ট-ইয়ার স্টুডেন্ট, সে কলেজেও যায় এই সাইকেল নিয়ে, ওর বাড়ি থেকে কলেজ
যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক তো লাগেই... কলেজে ওর সহপাঠীরা যেখানে হাই-ফাই বাইকে
মেয়েদের পেছনে বসিয়ে কলেজে যায়, সেখানে ওর এই মার্কামারা সাইকেল নিয়ে কলেজ
যাওয়াটা সকলের হাসির উদ্রেক তৈরী করে। ওর তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
আসলে এই সাইকেল ওর প্রাণের থেকেও প্রিয়, ওর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ও
যখন ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠলো তখন ওর দাদু কিনে দিয়েছিল। দাদু ওর ভীষণ
প্রিয়। যাবতীয় আবদার ওর দাদুই পূরণ করত। সেই দাদুই মাধ্যমিক পাস করার পর
বাইকও কিনে দেবে বলেছিল, কিন্তু বাদ সাধে ওর বাবা। বাইক কেনা আর হলো না।
দাদুও সেই বছর মারা গেল, তারপর থেকে ও একাই হয়ে যায় বলা যেতে পারে, দাদুর
স্মৃতি বিজরিত এই সাইকেলটাই ওর সম্বল। ও সাইকেলটা কোনরকম কাছছাড়া করে না।
ক্লাস টুয়েল্ভ্ পড়ার সময় রিনার সাথে পরিচয় হয়েছিল, যার সাথে ওর নিবিড়
বন্ধুত্ত্ব গড়ে উঠেছিল। ওকে রোহন খুবই ভালোবাসে। পড়াশোনার ব্যাপারে দুজনের
বোঝাপড়া ভীষন ভালো। একে ওপরের উপর নির্ভরশীল। একই সাথে কোচিং-এ যাওয়া বা
মাঝে মাঝে ঘুরতে যাওয়া সবই হতো। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে ওদের
বন্ধুদের মধ্যে জোর আলোচনাও হতো। কিন্তু মুখ ফুটে রোহন রিনাকে ভালোবাসার
কথা বলতে পারেনি, হঠাৎ করে একদিন রোহন রিনার বাড়ির ছাদের ঘরে ওর হাত ধরে
বলেছিল, ‘রিনা, তোকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তুইও কি আমাকে...’ রিনা থামিয়ে
দিয়ে, ‘আমি আপাতত এই নিয়ে ভাবিনি রে, চল অরগানিক কেমিস্ট্রির সাজেশন নিয়ে
একটু আলোচনা করা যাক’... রোহন রিনার মুখে এক ঝিলিক হাসি লক্ষ্য করেছিল
সেদিন... কিন্তু রিনা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। এরপর রোহন আরও অনেকবার
প্রোপোস করেছিল, রিনার তরফ থেকে কোনো সাড়াশব্দ সেভাবে পায়নি... রিনা হেসেই
উড়িয়ে দিয়েছিল।
ওরা সুবিরবাবুর কোচিংয়ে একসাথে অঙ্ক করতে যেতো। রোহন
সাইকেল নিয়ে সেখানে পড়তে যেতো। রিনাকে ওর বাবা বা মা দিয়ে আসতো। মাঝে মাঝে
রিনা একাও আসতো, বাড়ি যাবার সময় রাত ৮টা বেজে যেতো সেক্ষেত্রে রিনা কোনো
ছেলেবন্ধুর বাইকে করে চলে আসতো। রোহন রিনাকে বলত, ‘আজ তোকে সাইকেল করে পৌছে
দেব’। রিনা একপ্রকার তাচ্ছিল্য করে ‘তোর ঐ ওল্ডমার্কা ঢড়ঢড়ে সাইকেলে আমি
চড়বো না, প্লিজ আমাকে বলিস না এভাবে’... রোহন নির্বিকার হয়ে থাকতো আর মুচকি
হাসতো। ও হতাশাও প্রকাশ করেনি কোনোদিন।
ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়ও
ওরা সুবিরবাবুর অঙ্ক ক্লাসে আসতো। রোহনের বারবার প্রোপোসেও রিনা
বিন্দুমাত্র সাড়া দেয়নি এবং বিরক্তও দেখায়নি। রিনাও তো রোহনকে ভালোভাবে
চেনে বা বোঝে। দুজনের মধ্যে কথা, খুনসুটির সব কিছুর সাক্ষি এই সাইকেল।
রিনাও এই সাইকেল নিয়ে অনেকবার খোঁটা দিয়েছে, ওকে বলেওছে যে একটা বাইক কিনতে
এবং সেই বাইকেই ও চড়বে বলে জানিয়েছে। কিন্তু রোহন এই সাইকেলের সাথে দাদুর
স্মৃতির ব্যাপারে রিনাকে কোনোদিনই কিছু বলেনি। রিনাকে বললে হয়তো বুঝে যেতো।
একদিন রোহনের জ্বর হয়েছে সেই অবস্থায় সুবিরবাবুর কোচিং-এ গেছে...
সেদিন ও আর রিনা ছাড়া আর কেউ ক্লাসে আসেনি। রিনাও সেদিন একা এসেছিল তারপর
ক্লাসের শেষে রাত ৮টার সময় একা একাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, কোচিং থেকে
বাড়িতে যেতে প্রায় ৪৫ মিনিট লাগে। রাতের পর রাস্তাও প্রায় অন্ধকার। মেয়েদের
পক্ষে একা বাড়ি যাওয়াও যথেষ্ট নিরাপদ নয়। রোহন তাই বলল, ‘কিরে অন্তত আজ
আমার এই সাইকেলে বসে চল’... রিনা আপত্তি জানালো না। সে সাইকেলের ফ্রন্ট
স্ট্যান্ডে উঠে পড়লো। রোহন রিনাকে সাইকেলে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলতে শুরু
করলো। রিনার শরীর রোহনের শরীরে স্পর্শ করলো। প্রায় প্রথম স্পর্শে রোহন কেমন
যেন বিহ্বল হয়ে পড়ল। ইচ্ছা হলো রিনার উন্মুক্ত পিঠে একটা ঠোঁটের ছোঁয়া
দেবার, কিন্তু ও আড়ষ্ট হয়ে সাইকেল চালাতে লাগলো। রিনা ওকে যেন ভুল না বোঝে।
কিন্তু ওর ধারনা ভুল প্রমাণ করে রিনা ওর বুকের ওপর মাথাটা রাখতেই রোহন
জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে কিছু বলবি’
- তুই তো বলিস, বলেই ফেল আবার
-
আমার আর বলার কি আছে, গত দু’বছর ধরে একই কথা বলতে বলতে তোর কান পচে গেছে।
ছাড়... আর সাহস হয় না... তুইতো আমার ভালোবাসা বুঝতেই পারিস না।
- তুই যেন খুব বুঝিস, মাথামোটার মত কথা বলিস না। সব কথাই কি মুখেই বলতে হয় রে। আমার চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিস কোনদিন...
- না... কি হবে তাকিয়ে... তুই কতবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিস, চোখের দিকে তাকাতে সাহস হয় না।
- তুই তো আহাম্মক, বোঝার ক্ষমতা তোর তো একদমই নেই...
- ঠিক আছে, আমি অবুঝ... বেশি কথা বাড়িয়ে কি হবে, আমার শরীর ভালো নেই, জ্বর
হয়েছে, তোকে বাড়ি পৌছে দিয়েই বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। মাথাটা বেশ ব্যাথা
করছে। বুঝতে পারছিস না, বুকের ওপর মাথাটা দিয়ে আছিস...
- তোর এই গরম
বুকেই আমার আস্তানা রে... তুই না এক্কেবারে বোকা... আমার অবুঝ লাভার তুই...
খুশি তো... এবার তোর ইচ্ছাটা পুরণ করতে পারিস...
- কি ইচ্ছা ?
- এই যে এতক্ষণ ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে যেটা তোর মনে হচ্ছিল। ভীতুর ডিম কোথাকার...
রোহন বুঝতে পারে। কিন্তু কিভাবে রিনা বুঝতে পারল ওর মনের গোপন ইচ্ছা। যাই
হোক ও জিজ্ঞাসা করলো না। রিনার পিঠে আলতো করে ঠোঁটের ছোঁয়ায় বুঝিয়ে দিল।
নিজেকে এখন বেশ হিন্দি সিনেমার হীরো মনে হতে লাগল। শরীর থেকে গরম আভাস কোথা
থেকে উবে গেল। মাথার ব্যাথাও কমে গেল। নতুন উদ্যমে ও সাইকেল নিয়ে রিনার
বাড়ির কাছাকাছি চলে এল। রিনার বাড়ির দরজার কিছু আগে একটু অন্ধকার। ও সাইকেল
রেখে রিনার হাত ধরে দরজার পাশে একটি দেওয়ালের কাছে চলে এল, যেখান থেকে
ওদের আর কেউ দেখতে না পায়। রিনা ওকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে সোহাগী
ভালোবাসায় মেতে উঠল। রোহনও নিজেকে মুক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে বুঝিয়ে দিল,
‘রিনা আমি তোকে খুব ভালোবাসিরে’
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাইকেলের হেডলাইটটা
মনে হল একবার জ্বলে উঠলো। হয়তো রোহনের দাদু সাইকেলের মধ্যে নিজের উপস্থিতি
জানান দিল যে, “অবশেষে আমার নাতি একটা নাতবৌ পেলো”।
প্রকাশিত - পদক্ষেপ পত্রিকা, চুঁচুড়া - ২০১৭ বইমেলা সংখ্যা