জীবনের খেলায়
*নিজেকে খুঁজে পাওয়া*
রাজকুমার ঘোষ
আরোগ্য নিকেতন নার্সিং হোমের গেটের সামনের রাস্তায় গত কদিন ধরে কৌতুহলী জনতার ভীড়ে নাজেহাল অবস্থা। অবশেষে স্বস্তির নিঃশ্বাস। লোকাল এম.এল.এ'র মা কদিন ধরেই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষছিল। এম.এল.এ তথা পাড়ার সবার দাদা পতা ওরফে প্রতাপ ধারা নার্সিং হোমের ম্যানেজমেন্টকে শাসিয়ে ছিল - আমার মাকে বাঁচাতে না পারলে গোটা নার্সিং হোমকে উড়িয়ে দেবো৷ শালা কাউকে ছাড়বো না।
তার এই শাসানিতে সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু ডাক্তার সুবর্ণ ঘোষালের কৃতিত্বে মৃতপ্রায় পতার মা ফিরে পায় জীবন। ডাক্তারের অসাধ্য সাধন ৷ পতা আপ্লুত। কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারের পা ধরে বলেছিল
- ভগবানকে আজ দর্শন করলাম৷ ডাক্তার আপনি না থাকলে মাকে ফেরাতেই পারতাম না। আজ থেকে এই পতা আপনার গোলাম। যখন যেমন প্রয়োজন পড়বে এই পতাকে স্মরণ করবেন, এই পতা তার সাথীদের নিয়ে আপনার দরবারে হাজির হয়ে যাবে।
এদিকে ডাক্তার সুবর্ণ ঘোষালের জয়জয়কার। মিডিয়া থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে তার এই অসাধ্য সাধন ছড়িয়ে পড়েছে। অপারেশন সফল ভাবে হওয়ার পর মিডিয়ার ভীড় নার্সিং হোম চত্বরে হয়েছিল, মিডিয়ার লোক একটি বারের জন্য ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চায়। ডাক্তার মিডিয়ার কাছে এসে জানায়
- আজ থাক, আমি ভীষণ ক্লান্ত। আপনারা এক কাজ করুন, দুদিন বাদে পুজো শুরু। ষষ্ঠীর দিন সকালে আমাদের বাড়ি চলে আসুন। সেদিনই আমি কথা বলবো।
ষষ্ঠীর দিন সকাল, ডাক্তার সুবর্ণ ঘোষালের বাড়ি। বাড়ির সামনে বিশাল পুজোর চাতাল। সেখানে পুজোর আয়োজনে অনেকেই ব্যস্ত। হয়তো খানিক বাদে ঠাকুর চলে আসবে। মিডিয়ার লোক আস্তে আস্তে আসতে শুরু করেছে। তারা আজ ডাক্তার সুবর্ণ ঘোষের সাক্ষাৎকার নিতে চায়।
যথা সময়েই ডাক্তার প্রেসের লোকের সামনে চলে এলো। একজন সাংবাদিক ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনি তো যুব সম্প্রদায়ের কাছে একজন আইকন। এম.এল.এ প্রতাপ ধারার মা যিনি কোমায় চলে গিয়েছিলেন, তাকে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়ে দুর্দান্ত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
- আমি আমার কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছি। একজন রোগীকে সুস্থ করার দায়িত্ব সকল ডাক্তারের কর্তব্য। হ্যাঁ রোগির অবস্থা ভীষন জটিল ছিল। সেখান থেকে ওনাকে আমি সুস্থ করেছি। একটা কথা বলি, আমাকে কৃতিত্ব না দিয়ে বরং পতাকে দিন। ওই ওর মাকে ফিরিয়ে এনেছে।
উপস্থিত সকল মিডিয়ার লোক ডাক্তারের এই কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানকার পরিবেশ নিস্তন্ধ। তাদের মধ্যেই একজন বলে উঠলো, ঠিক বুঝলাম না।
- পতা হলো ওর মায়ের আদর্শ সন্তান। গত এক সপ্তাহ ধরে সে সন্তান তার সমস্ত কাজ কর্ম ভুলে তার মায়ের সুস্থতার জন্য নার্সিং হোমের ভিজিটিং রুমে দিনরাত এক করে দিয়েছে। তার মা সুস্থ না হয়ে পারে না। হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি। ওর মায়ের প্রতি ব্যকুলতা আমাকে আরও জেদি করে তুলেছিল, যে করেই হোক আমি ওর মাকে সুস্থ করে তুলবো।
একজন সাংবাদিক বলে,- এতো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, যে এক মা এর প্রতি তার সন্তানের ব্যকুলতা থাকবে।
- না, পতার মত কারোর নেই। এমন কি আমারও নেই। আপনাদের কথা অনুযায়ী আমি একজন সমাজের জনপ্রিয় ডাক্তার। সমাজের গণমান্য প্রতিনিধি। আমি কি করেছি আমার বিধবা মার জন্য। এই দেখুন আজ পুজোর ষষ্ঠীর দিন। বাড়িতে ঠাকুর আসছে। সবাই ব্যস্ত। আমার স্ত্রী নতুন শাড়ীতে সজ্জিত সাথে তার মাকেও নতুন শাড়ীতে সাজিয়ে রেখেছে। কেন আমার মাকে সাজায়নি? আমার মা যে এই ঘরের এক কোণে পড়ে আছে। যে তার সন্তানের কামনায় সারা দিন রাত ভেবে থাকে। আমিই বা কিরকম সন্তান। যাকে একটুও সময় দিতে পারি না। প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে যাই, ফিরি রাতে। আমার মায়ের দিকে ঘুরেও তাকাইনা। সে কি খেলো? সে কি পড়লো? তার শরীর কেমন আছে? শুধুই ব্যস্ততা আর টাকা পয়সার পেছনে ছুটে চলা। কিন্তু পতা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। ওর করুণ আর্তি আমাকে সব কিছু মনে করে দিয়েছে। জীবনের খেলায় পতা আমার মত নামমাত্র এক অখ্যাত-বিখ্যাত ডাক্তারকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে৷ ওর এই মনোভাবকে কুর্ণিশ জানাই। আমার ডাক্তার হওয়ার পেছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন আমার মা। আমার জগৎ জননী। আজ ষষ্ঠীর দিনে আমাদের বাড়িতে মা দুর্গার মূর্তি আসছে। সকলে ব্যস্ত মাটির এই মূর্তিকে স্বাগত জানাতে। অথচ ঘরের মধ্যে একজন জীবন্ত মা দূর্গা আছে তার দিকে ঘুরেও তাকাচ্ছি না। ছি ছি ধিক্কার জানাই আমাদের মত সন্তানকে। তাই আমি ঠিক করেছি আজ থেকে প্রতিটা দিন আমি আমার মায়ের সাথে একটু হলেও সময় দেব, মাএর সাথে থাকবো। এই পুজোর কদিন আমি আমার দুর্গা মার সাথে কাটাবো সারাক্ষণ।
একজন মিডিয়া সাংবাদিক তাদের শিরোনামে নতুন করে শব্দ সাজাচ্ছেন, ডাক্তারের মহানুভবতা আরও একবার সকলের সামনে ... ডাক্তার সুবর্ণ ঘোষাল সেই শব্দগুলো লক্ষ্য করেই ছুটে এলেন তার কাছে, উনি বললেন – আমি দেবো নতুন শিরোনাম... অবশেষে একজন ডাক্তার প্রকৃত মানুষ হওয়ার রাস্তা খুঁজে পেলো।
তিনি আরও বললেন, এ শুধু আমার জীবনের ক্ষেত্রে নয়, এই সমাজের সকল মানুষের কাছে বার্তা। সকল ব্যস্ত মানুষ তাদের জীবিত বয়স্ক মায়েদের জন্য যেন একটু সময় দেন। বিধবা মায়েদের শেষ আশ্রয় যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়।
প্রকাশিতঃ আমাদের লেখা পত্রিকা, (সবুজ পত্রিকা), ২০১৯
No comments:
Post a Comment