রাজকুমার ঘোষ -
পটলা অজ পাড়া-গায়ের ভীষণ গরীব পরিবারের ছেলে। ধোপার কাজ করে ওদের সংসার খুব
কষ্টে চলত। ওদের পরিবার তথা গোটা পাড়ার মূল উপার্জন ধোপার কাজের উপরই নির্ভর করত। চার
পুরুষ ধরে ওদের পারিবারিক কাজ এখন সেভাবে আর হয়না। তারপর ওই একমাত্র ছেলে, দুই
দিদির সাথে দুই বোনও আছে। সংসারের হাল ধরতে ওকে শহরে চলে আসতে হয়। এক পরিচিতের সুপারিশে সে এক ধনিবাবুর বাড়িতে
কাজের সুযোগ পায় এবং তার সাথে বাইশ বছরের পটলার প্রথম বার শহরে পা রাখা। ভালোই
লাগে তার... সে বাবুর বাড়ির কিছু কাজ করে এবং বাবুর একটি রেস্টুর্যান্টের
দেখাশোনাও করে। বিকালে কাছাকাছি একটি পার্কে যায়, অনেক কিছুই দেখে তার ভালোই লাগে।
আর একটা জিনিস ওর খুবই প্রিয়... তা হল টিভি,
যেটা ওকে আরও ভালো রেখে দিয়েছে। সারাদিন টিভিতে কত যে বায়োস্কোপ হয় তার ঠিক নেই...
সেই রকমই একটি বায়োস্কোপ দেখে ও ভীষন ভাবে অনুপ্রানিত হয়ে পড়ল। গল্পের নায়ক ঠিক যেন ওর মত... গ্রাম থেকে শহরে
এসেছে ... হাতে একটি চ্যালা বাঁশ আর সবসময় তেল মাখিয়ে চকচক করে। আর সেই তেল মাখানো
চ্যালা বাঁশটি নিয়ে নায়কের কত হম্বিতম্বি ! সুন্দরী হট নায়িকাও নায়কের প্রেমে
অন্ধ, নায়ককে জড়িয়ে কত নাচ-গান, তারপর চুমা-চাটি ... পটলা নিজেকে সেই নায়কের
জায়গায় রেখে দিয়েছে এবং সাধ করে একটি চ্যালা বাঁশও জোগাড় করে ফেলেছে, আর তাতে প্রতিদিন যত্ন করে
তেলও মাখিয়ে রাখছে। বাঁশটিও আসতে আসতে পটলার তেল মাখানো যত্নে চকচকে হয়ে
উঠেছে।
একদিন পটলা তার তেল মাখানো বাঁশটি নিয়ে সেই নায়কের মত
কেতা করে পার্কে ঘুরতে গেছিল। হঠাৎ সেখানে একটি হট মেয়েকে দেখে পটলা উৎফুল্ল হয়ে
পড়ল। মেয়েটিকে বেশ দেখতে, তারপর একটি হাফ প্যান্ট ও পরনে একটি টাইট গেঞ্জী... ব্যাস
আর দেখে কে ? ... বেশ উত্তেজিত হয়ে সে সেই বায়োস্কোপে দেখা নায়কের মত কায়দা করে
মেয়েটির সামনে দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে পড়ল। মেয়েটি দারুন চমকে গেল তার পর ‘এই
গাঁইয়া... চল ফোট’ বলেই ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পটলাও দমবার পাত্র নয়, সেই নায়কের
ভূত তার মাথায় চেপে বসে আছে... সে মেয়েটির পিছু নিল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আর দেখতে
পেল না। মনটা খারাপ করে এদিক ওদিক ঘুরতে
ঘুরতে হঠাৎ নজর গেল একটি ঝোপের দিকে, সেই জায়গাটি বেশ নিরালা ... আশেপাশে কেউই
নেই। পটলা বেশ খুশি মনে এগিয়ে গেল সেই ঝোপের দিকে, সেখানে গিয়েতো পটলার চক্ষু চড়কগাছ।
সেখানে গিয়ে আড়াল থেকে দেখে ঝোপের মধ্যে সেই মেয়েটির সাথে একটি ছেলেও আছে, মেয়েটির
পরনে কিচ্ছুটি নেই, আর অদ্ভুত সব গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেল, যা দেখে পটলার মুখে,
‘ছিঃ ছিঃ... অসভ্য...! অসভ্য...!’ । পটলা রেগে গিয়ে সেখান থেকে চলে এল এবং তার
মনটাও খারাপ হয়ে গেল।
সে নিজের বাসায় ফিরে প্রথমেই চ্যালা বাঁশটা ছুঁড়ে ফেলে
দিল। রাগে ফেটে পড়ল... অবশেষে নিজের অবস্থার কথা ভেবে শান্তও হল। এদের সাথে পাল্লা
দেওয়া পটলার কম্ম নয়। যাই হোক সে আবার বাঁশটিকে তুলে নিয়ে পরম যত্নে আরো তেল দিয়ে
সেবা করতে লাগল আর বাবুর বাড়ি ও রেস্টুর্যান্টে মন দিয়ে কাজ করতে থাকল, কিন্তু
টিভি দেখা প্রত্যেকদিন তার চাইইই।
তিনমাস পর, একদিন পটলা তার
বাবুর রেস্টুর্যান্টে মন দিয়ে কাজ করছিল। সেদিন প্রচুর ঝড়জল হচ্ছিল। রেস্টুর্যান্টে
কেউই আসেনি সেভাবে, সে একাই ছিল ... সেই ফাঁকে সে রাতের খাবার তৈরির ব্যবস্থা
করছিল... আর বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল। রেস্টুর্যান্টের বাইরে একটি মেয়ে
এসে দাঁড়াল। বৃষ্টিতে পুরো ভিজে গেছে, একটু মাথা বাঁচাবার জন্য সে রেস্টুর্যান্টের
ভেতরে ঢুকে পড়ল। মেয়েটির পরনে ছিল সাদা রঙের শাড়ি ... বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে মেয়েটির
শাড়িটি শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। পটলা মেয়েটির শরীরটিকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে... কিন্তু
মুখের দিকে চোখ যেতেই সে চিনতে পেরেছে মেয়েটিকে, এই মেয়েটি হল সেই ঝোপের মধ্যে
গোঙানী... ‘থাক থাক থাক’ এই বলে পটলা নিজেকে স্থির করল। সে আর তাকালো না, নিজের
কাজ করতে লাগল। হঠাৎ পটলা দেখল মেয়েটি ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছে তারপর ওকে ‘আমাকে
প্লীজ বাঁচান’ বলে হাতটাকে চেপে ধরেছে। পটলা মেয়েটিকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
‘তোমার মত অসভ্য মেয়েকে বাঁচাতে আমার বয়েই গেছে, যাও এখান থেকে’ এটা বলার পর মুখ
তুলে তাকালো এবং বুঝতে পারল যে জনা তিনটে ছোকরা মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছে।
তাতেও পটলা বিচলিত না হয়ে মেয়েটিকে বলল, ‘আরে যাও ওদের সাথে, তোমার তো ওদেরই
পছন্দ’ ... কিন্তু কোথা থেকে একটা হাত
পটলার চোয়ালে বেমক্কা পড়তেই পটলা ছিটকে গেল এবং তার সাথে তিনজন মিলে অনেক
জানোয়ারের নাম দিয়ে, বোকা-পাগলা আরও কত কি শব্দ দিয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ
করতে লাগল, সেসবের মধ্যে ওর বাবা-মাকেও
কোথা থেকে টেনে আনল। ব্যাস পটলার মাথা ঘুরে গেল, তারপর সে কোথা থেকে সেই তেল
মাখানো বাঁশের চ্যালাটা নিয়ে তিন ছোকড়াকে রামধোলাই দিল। আর নিজেও ধোপার কাজ
করেছিল, সেই জামা কাপড় কাচার মতই তিনজনকে ধরে এমন ঠ্যাঙালো, ওরা সেখান থেকে পালাল।
এদিকে মেয়েটি এবার ওকে আরো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমিই আমার উদ্ধার কর্তা... আমি এবার
কোথায় যাব?’ পটলা বলল, ‘আমি আর আমার এই তেল-বাঁশ তোমাকে বাঁচাইনি, বাবা-মাকে
গালাগাল দিল বলেই...’ , পটলা মেয়েটিকে আরও অনেক কথা বলল, আর সেদিনের ঝোপের কথাও
জানাল... মেয়েটি তার অবস্থার কথা বলল... সে তার মাকে বাঁচানোর জন্যই এত জঘন্য কাজ করে আসছে ... মেয়েটি কথা দিল, পটলা
যদি ওকে মেনে নেয়, তাহলে আর এই কাজ করবে না... এবার পটলা খানিক চুপ... তারপর সে
তার তেল মাখানো বাঁশটিকে সেখান থেকে নিয়ে চলে এল রেস্টুর্যান্টের ঠাকুর ঘরে, মা কালির
চরণের কাছে গিয়ে, ‘হে মা...! বায়োস্কোপের
বাঁশ-তেল তাহলে সত্যি ... !’, বলেই হো হো
হো করে আনন্দে হাসতে লাগল।
No comments:
Post a Comment