Thursday, March 26, 2020

বড়গল্প - উত্তরণ



রাজকুমার ঘোষ

যত নষ্টের গোড়া শালীটা...” শ্যামল আজ খুব রেগে আছে বিনুর ওপর
কি দরকার ছিলো নিজেদের সুখের কথা ওর বৌ রাণুকে জানানোর মানলাম তোর বর ফ্যাক্টরীতে কাজ করে, ওভারটাইম করে মাস গেলে ভালো টাকা রোজগার করে তোকে গয়না কিনে দেয়, বেড়াতে নিয়ে যায় ভালো কথা কিন্তু সেটা ফলাও করে রাণুকেই জানাতে হবে - নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে শ্যামল আজ সকাল থেকে বেড়িয়েছে টোটো নিয়ে কিন্তু ভাড়া আজ সেভাবে হচ্ছে না তার ওপর মেজাজটাও বিগড়ে আছে ওর বৌ রাণু আজ ওকে বলেছে,
- রাতে আদর করার সময় মনে থাকে না, বৌকে সুখে রাখতে হয়... দেখো বিনুকে, ওর বর ওকে গয়না কিনে দিয়েছে, পুরীতে বেড়াতে নিয়ে গেছে আর তুমি লবডঙ্কা...!”
এটা শোনার পর শ্যামলের মনে হচ্ছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে কিন্তু চোখের সামনে ওর বছরের ছেলেটার মুখ ভেসে আসে নিজেই জানেনা, কিভাবে সংসারটাকে গুছিয়ে নেবে, টোটো চালিয়ে সংসারটা কোনোমতে টানছে তার ওপর আবার বিনুকে দেখে রাণুর বায়ানাক্কা রাণুরতো বোঝা উচিত, টোটো চালিয়ে সে যে টাকা রোজগার করে সেটা পুরোটা তার নয় টোটোর মালিককে হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে তবেই না বাকিটা তার নিজের...কিন্তু রাণু বুঝবে না বিনু এই কিনেছে বিনুর বড় করেছে ‘যত্তসব!’- নিজের অজান্তেই শ্যামল বললো, ‘দূর শালা আজ ঘরেই যাবো না বুঝুক একদিন স্বামী ঘরে না থাকলে কি হতে পারে?’
শ্যামল আন্দুল স্টেশন থেকে ভাড়া ধরে আজ রবিবার সেভাবে ভাড়া পাচ্ছে না প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে সে ঠায় বসে রয়েছে আর যত পুরনো কথা ওর মনে আসছে রাণুর প্রিয় বন্ধু বিনু দুজনের মধ্যে প্রাণের কথা হয়েই থাকে বছর হয়ে গেলো শ্যামলের সাথে রাণুর বিয়ে হয়েছে প্রথম প্রথম এতো ঝগড়া হতো না বিনুর বিয়ে হওয়ার পর থেকেই ওর সংসারে টুকটাক অশান্তি লেগেই থাকে প্রেম করে বিয়ে করেও এতো অশান্তি বিনুর বর কারখানায় কাজ করে ভালো মাইনে পায় বিনুর সব সখ আহ্লাদ মেটায় রাণুর মনে এই নিয়ে অশান্তি এখন শ্যামলকে কিছুতেই বুঝতে চায় না টোটো চালিয়ে সব সখ পূরণ হয় না শ্যামল ভাবে কষ্টের সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে হলে এবার ওকে ডাকাতি করতে হবে এইসব ভাবতে ভাবতে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এসেছে ওর টোটোর কাছে ওনাকে নিয়ে যেতে হবে মুন্সিরহাটে বেশ দূরের ভাড়া বয়স্ক লোকটিকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে ওনার হাতে অনেকগুলো ব্যাগ সেগুলো নিয়ে বেশ পরিশ্রান্ত শ্যামল ওনাকে বসিয়ে মুন্সিরহাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ভদ্রলোক মোবাইলে কার সাথে কথা বলছে –
 'ভেবো না আমি সব যোগাড় করেছি আমি এখন আন্দুলেই আছি বিজনবাবুর সাথে কথা হয়েছে উনি সব কিছু ব্যবস্থা করেছেন দলিলটা উনি রেখেছেন আমার সোনা মার বিয়ে ধুমধাম করে দেবো আর ছেলেদের বলো তাদের বোনের বিয়ে নিয়ে ভাবতে হবে না সোনা মার বাবাই যথেষ্ট'
শ্যামল বুঝতে পারলো ভদ্রলোকের মেয়ের বিয়ে প্রায় দু ঘন্টা টোটো চালিয়ে শ্যামল মুন্সিরহাটে ভদ্রলোকের বাড়িতে চলে এলো ভদ্রলোককে পৌঁছে দিয়ে একটা হোটেলে শ্যামল দুপুরের খাবার খেলো ঠিকই করেছে আজ রাত ১১টার আগে বাড়িতে কিছুতেই ঢুকবে না হোটেলে খাওয়ার পর শ্যামল আন্দুলের দিকে ফিরে আসার পথ ধরলো কিন্তু ডোমজুড়ে টোটোটা হঠাৎই বিগড়ে গেলো টোটোর ব্যাটারিতে চার্জ নেই ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়ার জন্য সে খোঁজ খবর করতে লাগলো অবশেষে একটা সাইকেল রিপেয়ারিং এর দোকানে সন্ধান পেলো সেই দোকানে ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার সময় সে খেয়াল করলো টোটোর সিটের খাঁজের মধ্যে একটা ব্যাগ পড়ে আছে বেশ ভয় পেয়ে গেলো সে ব্যাগটি হাতে নিয়ে দেখলো অনেকগুলো ২০০০ টাকার নোট টাকা ভর্তি ব্যাগটা হাতে নিয়ে শ্যামলের মাথা ঘুরে গেলো এই ভরা শীতকালেও অনুভব করলো ওর পরনের জামা ঘামে ভিজে যাচ্ছে কোনোরকমে ব্যাটারিতে চার্জ দিয়ে শ্যামল টোটো নিয়ে বিকালে বাড়ি চলে এলো ব্যাগ ভর্তি টাকাগুলো খুব সাবধানে বাড়িতে নিয়ে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেখতে থাকলো যে কত টাকা ব্যাগে আছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকার মতো ক্যাশ আছে ভাবলো এবার ভগবান ওর দিকে তাকিয়েছে টাকাগুলো ভেবেচিন্তে কাজে লাগাতে হবে ভাবে একটা টোটো কিনে যদি নিজের মত করে চালানো যায় তাহলে সংসারে বেশ কিছু পয়সা আসবে আর বৌ-এর সখ আহ্লাদও পূরণ করা যাবে কিছুক্ষণ পরে রাণু ফিরে এলো রাণু ফিরে আসতেই আরম্ভ হলো ওকে দেখেই যেন রাণুর মাথা গরম হয়ে গেলো
- আজ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে হায়রে আমার কপাল কার সাথে ভগবান আমার বিয়ে দিয়েছো
- কি হলো রাণু; আমাকে আর সহ্য করতে পারোনা কেন? প্রতিদিন তোমার এই টিপ্পনি আর ভালো লাগছে না আমি তো চেষ্টা করছি নাকি
- সেতো দেখতেই পাচ্ছি ওদিকে বিনুর বর কত কি ভাবে ওর জন্য আমি এইতো ফিরলাম ওর বাড়ি থেকে এই মাসের শেষে ওরা দার্জিলিং যাবে ঘুরতে
- তুমি শুধুই ওদের দেখো আর আমার সাথে ঝগড়া করো আমিও আজ একটা জিনিস পেয়েছি তোমাকে বলবো না একটা নিজের টোটো কিনবো ঠিক করেছি
- মানে! কি বলছো তুমি? এত পয়সা কোত্থেকে পেলে তুমি?
- বলে কি হবে তোমায়? যাও না শুধু বিনুর বাড়ি
রাণুর গলা একটু ঠান্ডা হলো এবার সোহাগী হয়ে শ্যামলের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
 - তুমি তো জানো আমার মাথা গরম হয়ে যায় কি বলতে কি বলি আমার সোনাটা বলো এবার আমাকে তুমি তো জানো তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে তাই তোমাকেই আমি যাতা করে বলি ঠিক আছে একটা হামি দিচ্ছি এবারতো বলো কি হয়েছে
শ্যামল এরপর আজ ঘটে যাওয়া সবকিছু রাণুকে জানালো রাণুর চোখগুলো খুশিতে চকচক করে উঠলো রাণু এবার বললো,
- বিনুকে এবার আমি দেখাবো আমরাও অনেক কিছু করতে পারি শুধুই কি ওরা পারে!
সেদিন রাতে দুজনে পাশাপাশি শুয়ে ভাবছে আগামী দিনে কিভাবে একটা সুন্দর জীবন গড়ে তুলবে এরই মাঝে শ্যামলের মনে সকালের সেই বয়স্ক লোকের মুখটা ভেসে উঠলো এক কন্যাদায়গ্রস্ত বাবার অসহায়তা সবকিছুর সামনে চলে এলো সে উঠে বসলো বললো,
- 'আমি অন্যায় করছি রাণু আমি কাল সকালেই ভদ্রলোকের বাড়ি যাবো আর টাকাগুলো দিয়ে আসবো ওনার মেয়ের বিয়ে বুঝতে পারছো রাণু, টাকাগুলো এখন দেখতে না পেয়ে ওনার বাড়িতে কি অবস্থা উনিতো আত্মহত্যা করবেন এবারে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা উনি ওনার ছেলেদের কাছে ছোট হয়ে যাবেন'
রাণু চিৎকার করে জানালো,
- আমি অতকিছু জানিনা এই টাকা আমাদের কোনোমতেই হাতছাড়া করা যাবে না এই টাকা দিয়ে দিলে তুমি তো সেই লবডঙ্কা তোমার মুরোদ আমার জানা আছে
- সে তুমি আমাকে যাই বলো আমি ডাকাত নই আমি মানুষ নিজের সুখের জন্য আমি অন্যের কষ্টের টাকা নিতে পারবো না এই টাকা আমি তো কামাইনি রাণু এত লোভ ভালো না ভগবান আমাদের জন্য যা দিয়েছেন সেই নিয়েই থাকি কাল আমি দিয়ে আসবো টাকাগুলো তুমিও যাবে আমার সাথে
- এই যদি তোমার কথা হয় তাহলে তুমি আমার মড়া মুখ দেখবে
- এইরকম বলে না সোনা বোঝার চেষ্টা করো তুমি চাইছো এই ভাবে টাকা নিয়ে রোজগার করে আমাদের ছেলেকে মানুষ করবো এই টাকা অন্যের চোখের জল আমাকে এইভাবে লোভ করতে বলো না তুমি তো আমার বৌ কোথায় সঠিক রাস্তা দেখাবে বলো!
- যা ভালো বোঝো কর আমি আর কিছু বলবো না
শ্যামল বুঝলো রাণুর মন খানিক হলেও ভিজেছে সে ঠিক করে নিলো আগামীকাল যে করেই হোক ভদ্রলোকের হাতে টাকাগুলো তুলে দেবে এই পাপের থেকে মুক্তি পাবে উত্তরণ তো সে চায় জীবনে চলার পথে কিন্তু এইভাবে কখনোই নয় এই যুগে সবাই ছিনিয়ে নিতে চায় হয়তো আর্থিক উত্তরণ হয়কিন্তু মানবিকতার উত্তরণ ক’জনের হয় সে পেরেছে লোভকে হারাতে নিজের সুখের জন্য কোনোভাবেই অন্যের চোখের জল আনতে পারবে না তাতে রাণু ওকে আরও তাচ্ছিল্য করুক কোনো যায় আসে না
সকালে উঠে শ্যামল তৈরী হয়ে নিলো না আজ সে রাণুর সাথে এই নিয়ে আর কথা বলবে না ঠিক করে নিয়েছে সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল টোটো নিয়ে সে বেড়োবে এমন সময় সামনে হাজির হলো রাণু
-
কি ভাবছো; তুমি যা ইচ্ছে তাই করবে আমার কথার কোনো মূল্যই নেই এভাবে চলবে না আমাকে নিয়ে যাবে বললে যে! তুমি একাই মহান হবে! কেনো তোমার বৌ কি হতে পারে না? কি ভাবো আমাকে? আমি এতোটাই লোভী আমার স্বামী অনেক বড় মনের আজ যদি সাথে না থাকি তো কবে থাকবো বল? আমাকে ক্ষমা করো তুমি তোমাকে কতকি বলি আমি তুমি আমার বেস্ট স্বামী বিনুর বরের থেকেও
শ্যামল আজ খুব খুশি যাক জীবনে যার সাথ পাওয়াটা সবচেয়ে বেশী দরকার অবশেষে সেটা পাওয়া গেলো একটা ভালো কাজে তার বৌ আছে ভীষণ শান্তি পেলো শ্যামল শ্যামল টোটো নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো সাথে তার বৌ এবং সেই ভদ্রলোকের ব্যাগ ভর্তি টাকা টোটো এসে দাঁড়ালো মুন্সিরহাটে সেই ভদ্রলোকের বাড়ির সামনে বাড়ির সামনে বেশ ভীড় ভয় পেয়ে গেলো শ্যামল রাণু দুজনেই বাড়ির ভেতর ঢুকে জানতে পারলো ভদ্রলোকের টাকা খোয়া যাওয়ায় তার ছেলেরা ওনাকে যাতা ভাবে অপমান করেছে ভদ্রলোক রাতে সুইসাইড করার চেষ্টা করে কিন্তু ওনার মেয়ে দেখতে পেয়ে সবাইকে ডেকে নেয় এবং ওনাকে বাঁচায় ওনাকে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জানা গেলো, ভদ্রলোকে প্রাইমারী স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষকগ্রামের লোকের কাছে প্রিয় অতনু মাস্টারমশাই। বাড়ির আশেপাশের লোকের সাথে কথা বলেই শ্যামল ও রাণু হাসপাতালে চলে গেলো। ভদ্রলোকের সাথে দেখা করে জানালো তাঁর টাকা তাদের কাছে আছে। শ্যামল তার হাতে টাকা ভর্তি ব্যগটা দিয়ে বললো, ‘দেখুন মাস্টারমশাই, আপনার সব টাকা আছে কিনা’।
ছলছল চোখে মাস্টারমশাই জানালেন, ‘তুমি আজ আমাকে বাঁচালে বাবা। কি বলে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো জানিনা’
- কোনো কিছু বলতে হবে না মাস্টারমশাই। আমি কাল বিকালে ব্যাগটা দেখি আমার টোটোতে আছে। ভেবেছিলাম টাকাগুলো নিয়ে নেবো। কিন্তু আমাদের বিবেক তা হতে দেয়নি। সাময়িক লোভের জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।
- যে নিজের লোভকে জয় করতে পারে। সেই তো মহান বাবা। তুমি আমাকে বলো এরজন্য আমি তোমার জন্য কি করতে পারি?
- কিছু দরকার নেই আমাদের। ঠিকঠাক ভাবে আপনার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাক এটাই কামনা করি। অন্য লোকের টোটো চালিয়ে আমাদের গরিব পরিবারে ভগবান যেটুকু দেবেন তা নিয়েই আমরা খুশি। শুধু আপনার আশীর্বাদ চাই।
- আমার মেয়ের বিয়েতে তোমাদের আসা চাই। আর শোনো কোনো উপহার আমরা নেবো না তোমাদের থেকে। তোমরাই আমার কাছে বড় উপহার। আর তোমাদের জন্য একটা উপহার আমার তরফ থেকে অবশ্যই প্রাপ্য।

বিয়ের দিন শ্যামল রাণুকে নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের মেয়ের বিয়েতে গিয়েছিলো। বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের সাথে মাস্টারমশাই ওদের পরিচয় করে দিলেন। শ্যামলকে নিজের ছেলে হিসাবে মেনে নিয়ে মাস্টারমশাই সকলের সামনে রানুর হাতে একটা নতুন টোটো কেনার টাকা তুলে দিলেন। তিনি বললেন, এ জগতে নির্লিপ্ত থাকা যায় এর জ্বলন্ত প্রমাণ আমার এই ছেলে-বৌমা। খুব খুশি হচ্ছে আজ আমার মেয়ের বিয়েতে এরা উপস্থিত হয়েছে। আমি ভীষন খুশি যে আমি আমার এই ছেলে-বৌমার জন্য কিছু করতে পারলাম। তোমরা এইভাবে সততা বজায় রেখো আর তোমাদের এই বাবার মুখ উজ্জ্বল করো।
রাণু ওর স্বামী শ্যামলের দিকে তাকিয়ে রইলো, আজ ও ভাবছে এইভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সামাজিক ও মানবিকতার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। আজ সে খুব খুশি। ভীষণ গর্ব হচ্ছে ওর স্বামীর জন্য। এবার সে বিনুকে বলতে পারবে তার স্বামীর মত আর কেউ হতে পারবে না।  

 
প্রকাশিত – পদক্ষেপ পত্রিকা চুঁচুড়া, বইমেলা সংখ্যা ২০১৯