Sunday, June 2, 2019

গল্প - ব্যবধান





রাজকুমার ঘোষ -
()
অঙ্কের ছাত্র হিসাবে অর্ণব বরাবরই স্যারদের কাছে জনপ্রিয় ছিলো হায়ার সেকেন্ডারীর পর থেকে তার পুরোদস্তুর অঙ্ক নিয়েই ধ্যান জ্ঞান পরে অঙ্ক নিয়ে মাস্টার ডিগ্রী এবং পি-এইচ-ডি করে তারপর একটা কলেজে প্রফেসর হিসাবে চাকরী পেয়ে যায় এর সাথে টিউশানিও করে সে হায়ার সেকেন্ডারী পাশ করার পর থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের টিউশানি করে পরবর্তী কালে অঙ্কের স্যার হিসাবে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করে প্রফেসরের চাকরী পাওয়ার পরও সে টিউশানি বন্ধ করেনি প্রথম থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের অঙ্কের ভীত তৈরী করা, তার লক্ষ্য ছিল ব্যাপারে সে যথেষ্ট সাবলীলতা দেখিয়েছে এবং সাফল্যও পেয়েছে অঙ্কতে সে কত জটিল অঙ্ক সমাধান করেছে কিন্তু জীবনের অঙ্ক সে আজও মেলাতে পারেনি
অর্ণব অনেক ছাত্রদের সাথে ছাত্রীদেরকেও অঙ্ক শিখিয়েছে, তাদের অনেক কঠিন অঙ্কের সমাধান করে দিয়েছে, কিন্তু নিজের জীবনের অঙ্ক সেভাবে সমাধান করতে পারেনি মন দেওয়া-নেওয়াতে সে সকলের থেকে পিছিয়েই ছিল বলা চলে তবে সব হিসাবে উল্টে দিল কোনো একরাধা রাধা নামে একটি অল্প বয়সী মেয়ে ওর কাছে টিউশনের জন্য এলো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর অর্ণব ভাবতে পারেনি রাধার মতো একটা সোজা সরল মেয়ে ওর মনে ঝড় তুলে দিয়ে যাবে সে রাধাকে ভালোবেসে ফেললো কিন্তু ভালোবাসার কথা সে কিছুতেই জানাতে পারল না সময়, বয়স, সমাজ, সম্পর্ক এতো কিছু ফ্যাক্টর তার কাছে জটিল অঙ্কের রূপ নিলো যার সমাধান কি হবে ওর জানা নেই একটা বিরাট ব্যবধান এর অঙ্ক নিয়ে অর্ণব অবসরে আকাশপাণে শূণ্য দৃষ্টিতে শুধু রাধার কথাই ভেবে যায় ...
()
অর্ণব তার মনের কথা রাধাকে বলতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু রাধাকে দেখতে পেলে ওর মন ব্যকুল হয়ে উঠতো যখনই রাধা ওর কাছে আসতো, অর্ণব মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকতো অন্যান্য সকল স্টুডেন্টের সাথে তার যে শিক্ষকসূলভ মনোভাব, সেটা সে রাধার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতো না রাধার ছেলেমানুষী আচরণ বরং ওর ভালোই লাগতো যেখানে স্টুডেন্টদের অঙ্কের ভীত তৈরী করাই অর্ণবের মূল লক্ষ্য, সেখানে রাধার অঙ্কের ভীত কতখানি তৈরী হয়েছে বলা কঠিনতার চেয়ে বলা ভালো রাধার সৌজন্যে অর্ণবের লুকোনো প্রেমের ভীত বেশ শক্ত হয়েছে রাধার প্রেমে সে যে পুরোপুরি অন্ধ রাধার হাজার আবদার সে কিছু না ভেবেই মেটাতো রাধাকে তার ভারী আপনজন মনে হতে লাগলো
সময় বয়সের ঘেরাটোপে অর্ণব রাধাকে প্রেম নিবেদন করতে পারেনি সমাজ, সম্মান সম্পর্কের জাঁতাকলে তার মনের কথাগুলো আটকে আছে সে নাই হোক, অঙ্কের টিউশানি নিতে রাধা ওর কাছে আসতো, রাধার এই উপস্থিতি ওর কাছে অনেক পাওনা রাধার সাথে কথাও বলতে পারতো এটাও তার মনে বেশ সুখের সঞ্চার করেছে, সেটাই বা কম কি ! …… কিন্তু হঠাৎ করে আসা একটা ঝড় সেই সুখ টাকেও কেড়ে নিলো রাধার অবিবেচক বাবা এক বড়লোকের ছেলের সাথে রাধার বিয়ে ঠিক করলো রাধাও কিছু না বুঝে সেই ছেলেটির সাথে বিয়ে করে নিলো নিজের ভবিষ্যৎকে নিজের হাতে কোন নদীর মাঝে ফেলে দিলো সে নিজেই জানে না বিয়ের সাথে সাথে রাধার পড়াশোনাও কার্যতঃ বন্ধ হয়ে গেলো অর্ণবের হৃদয়েও গভীর শূণ্যতা তৈরী করে রাধা চলে গেলো ব্যবধানের মাঝেও শূণ্যতা কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো …………
()
রাধার বিয়ে হয়ে যাওয়াটা অর্ণব কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি রাধা স্টুডেন্ট হিসাবে ভালোই, একটা ভুল সিদ্ধান্ত সব আশায় জল ঢেলে দিলো অর্ণব ভারাক্রান্ত মনে স্টুডেন্টদের ক্লাস করে, সে সকলের মাঝে তার রাধাকে খুঁজে বেড়ায় এইভাবে তার দিন কেটে যায়, কিন্তু কাউকেও বলতে পারেনি যে ওর ভালোবাসার প্রদীপ নিভে গেছে রাতে ঘুমোতে পারে না, গভীর হতাশায় ভাবে, বোধ হয় রাধার সাথে জীবনে মিলিত হবার সব আশাই শেষ …… !
এইভাবে প্রায় ১২ মাস কেটে যাওয়ার পর…… ঠিক শরতের আকাশ, কাশফুলের বাহার সাথে মায়ের আগমণএই রকম একটা দিনে রাধা অর্ণবকে অবাক করে অন্যান্য স্টুডেন্টদের সাথে অঙ্ক ক্লাসে হাজির হল অর্ণব বেশ চমকে গেলো সে কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই রাধা জানায়, “স্যার, আমি আবার অঙ্ক করতে চাই” … খুব কৌতুহল হলেও অর্ণব তার চমকে যাওয়ার কারণটা জিজ্ঞেস করেনি একদিন ক্লাসে অর্ণব একা ছিলো, রাধা নিজে থেকেই তাকে জানায়, শ্বশুরবাড়ীতে তার অবস্থান ভালো নয়, তার স্বামী লম্পট, মাতাল, শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা রাধার ওপর অত্যাচার করেছে, তাই সে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে নিজের বাবার বাড়ীতে চলে এসেছে সে আবার পড়াশোনা করতে চায়রাধার চোখ জলে ভিজে যায়, সে অজান্তে অর্ণবকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে অর্ণব হতভম্ব, সে রাধাকে কি বলবে জানে নাসে কি রাধাকে তার ভালোবাসার কথা জানাবে ? … কিন্তু কিছুতেই সে বলতে পারলো না ভালোবাসার কথা বলার এটাই সঠিক সময় নয় অর্ণব তার আবেগ কে সংযত করে নিলো, রাধার চোখের জল মুছিয়ে দিলো সে রাধাকে আশ্বাস দিলো তার পাশে সে সর্বদা থাকবে রাধার এতো দুঃখের মধ্যেও অর্ণব কোথায় যেন একটা শান্তি পেলো তবে কি রাধা তার স্যার এর মন বুঝতে পেরেছে ?... অর্ণব নিজে থেকে ধরেই নিলো রাধা তার আপণজন ব্যবধান বুঝি এবারে ঘুচলো
রাধা আবার অঙ্ক ক্লাস করতে আসে, অর্ণবের সাথে তার একটা বিশ্বাস ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী হল সে খুব খুশী, সে এখন রাতের আকাশে তাকিয়ে দেখে তারাগুলো মিট মিট করে জ্বলে হাসছে আর চাঁদ ওকে স্যালুট করছে ………………
()
নতুন করে জীবন গড়ার লক্ষ্যে সে আবার পড়াশোনা আরম্ভ করলো অর্ণব রাধাকে আপণজন ভেবে ওর সব পুরানো ঘটনাকে ভোলাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলো আস্তে আস্তে রাধা জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এলো অর্ণব রাধার মধ্যে ভালো বোঝাপড়া তৈরী হয়ে গেলো অর্ণব ঠিক করে, পূজোর ছুটিতে সে রাধার সাথে আনন্দে কাটাবে, সেই অনুযায়ী সে প্ল্যানও করে ফেলে সপ্তমীর দিন ওরা এক সাথে মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে যাবে অর্ণব সেই দিন সকাল ১০টার সময় ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে রাধার জন্য অপেক্ষা করেছিলো, কিন্তু রাধা আসেনি হতাশ হয়ে অর্ণব ফিরে আসে, পরে রাধাকে ফোন করে জানতে পারে, রাধা তার প্রাক্তন প্রেমিকের সাথে নাকি শেষ দেখা করতে গিয়েছিলো অর্ণব সেদিন প্রচন্ড কাঁদে, রাধা তারপর ক্ষমা চেয়ে নেয় সেদিন থেকে অর্ণব নিজেকে কার্যতঃ গৃহবন্দী করে রাখে, পূজোয় একটা দিনও সে আর বেরোয়নি পূজো কেটে গেলো, রাধাও অঙ্ক ক্লাসে আবার আসতে থাকে আর অর্ণবের মনকে ব্যকুল করে চলে যায়
অর্ণব একদিন রাধাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়, রাধা তার বাড়িতে কথা বলতে বলে অর্ণবের বাবা রাধার বাড়িতে গিয়ে এই প্রস্তাবের কথা জানায় রাধার বাবা-মা ভাবতে পারেনি যে এমন সুন্দর একটা প্রস্তাব তাদের কাছে আসবে খুশিতে ওনাদের চোখে জল চলে এলো রাধাও এক প্রকার মৃদু সম্মতি জানায় এরপর থেকে রাধা অঙ্ক ক্লাসে খুব কম আসতে থাকে অর্ণব প্রায় ফোন করে রাধাকে অঙ্ক ক্লাসে নিয়ে আসে এই সময় খেয়াল করে রাধা নিয়মিত ক্লাসে আসে না, অথচ রাধা অঙ্ক ক্লাসে যাচ্ছে, বাড়ির লোক কিন্তু এটাই জানে অর্ণব ভাবে, বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার জন্য রাধা তার কাছে আসতে হয়তো লজ্জা পাচ্ছে
আর কিছুদিন পরেই অর্ণব রাধার সাথে সংসারের মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়বে, ওর ভালোবাসা এবার পূর্ণতা পাবে অর্ণব খুব খুশি অর্ণবের বাবা রাধার সাথে ওর বিয়ে ফাল্গুন মাসে ঠিক করেছে তার আগে অবশ্য ওদের আশীর্বাদের দিনও স্থির হয়েছে আশির্বাদের দিন চলে এলো, রাধার বাড়ির অভিভাবকরা অর্ণবকে আশীর্বাদ করতে আসবে ওর বাড়িতে বেশ অনুষ্ঠানের পরিবেশ, বেশ জমজমাট ব্যাপার একরাশ আনন্দ নিয়ে অর্ণব সকাল থেকে তৈরী হচ্ছিলো বেলায় রাধার বাড়ি থেকে একজন এসে জানায় রাধা ভোর বেলায় তার সেই প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে অর্ণবের বাড়ির সকলে এই খবরে বেশ হতাশ হয়ে পড়ে আর অর্ণব, সে বাড়ির ছাদে ছুটে চলে যায়, আকাশপাণে তাকিয়ে সূর্য কে জিজ্ঞেস করে, ‘কেনো ????’ ……
কিছুদিন পর...
অর্ণব বিয়ে করে ফাল্গুন মাসের সেই দিনেই অর্ণবের বাবা তার ছেলের বিয়ে দেন তবে পাত্রী রাধা নয় অর্ণবের বাবা নিজস্ব দায়িত্বে তড়িঘড়ি দেখাশোনা করে অন্যত্র বিয়ে ঠিক করেন এবং সময়ের মধ্যে বিয়ে দিয়ে দেন অর্ণবের স্ত্রী দেখতে সুন্দর, একটা স্কুলের দিদিমণীপাত্রী হিসাবে খুব খারাপ নয় অর্ণব তার স্ত্রীকে যথাযথ মর্যাদা দেয়, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু কোথায় যেন একটা শূণ্যতা অর্ণবের মধ্যে রয়ে গেছে সে অবচেতন মনে রাধার কথা ভাবে, আর কেঁদে ওঠে বিয়ের পরেও অর্ণবের জীবনে রাধা একটা বিরাট ব্যবধানের ছাপ রেখে গেলো

প্রকাশিত – স্বপ্ন উড়ান পত্রিকা, ২০১৬ উৎসব সংখ্যা