Saturday, June 1, 2019

গল্প - গুড়িয়া


রাজকুমার ঘোষ -


()

 
আজ আমার স্বপ্ন সার্থক রূপ নিলো গত কদিন ধরেই বিভিন্ন নিউজ পেপারে গুড়িয়া নিয়ে দারুন চর্চা বেশ ভালো লাগছে আমার, আজ প্রায় এক বছর গুড়িয়াকে সকলের মনে ধরেছে গুড়িয়া আজ স্বীকৃতি পেয়েছে হ্যাঁ, একটা পূর্ণাঙ্গ দৈর্ঘ্যের নাটক হিসাবে গুড়িয়াআজ সকলের কাছে সমাদৃত আমার জনপ্রিয় নাটক  গুড়িয়া একটা আদ্যপ্রান্ত প্রেমের নাটক নাটকটি দর্শকের মনে যে এত ঝড় তুলবে ভাবা যায় নি   এর জন্য আমাদের গোটা টিমটারই যত প্রশংসা করি ততই কম হয়ে যাবে গুড়িয়া নাটকের মূল চরিত্র গুড়িয়া ভূমিকায় আমাদের নায়িকা মোনালিসা চক্রবর্তীর অভিনয় এক কথায় অনবদ্য আমি, দিবাকর ঘোষ, গুড়িয়া নাটকটির নাট্যকার, তথা নায়কের ভুমিকাতেও আমি অভিনয় করছি এই নাটকটি আমারই রচনা, এই নাটক টিকে মঞ্চস্থ করাই আমার স্বপ্ন ছিল, যা আজ পূরণ হয়েছে খুব খুশি আমি, আমার এই দীর্ঘ নাট্যকার জীবনে গুড়িয়ার স্থান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কলেজ জীবনে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করেছি, অনেক নাটক নিজের হাতে পরিচালনা করেছি, অভিনয় করেছি কিন্তু আজ আমার স্বপ্ন গুড়িয়া সাফল্য আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে
 কলেজ জীবনে আমি অনেক মেয়ের সান্নিধ্যে এসেছি তাদের মধ্যে অনেকের সাথে আমি অভিনয়ও করেছি মাঝে মাঝে প্রেমও করেছি কিন্তু সেই ভাবে মনকে কেউ নাড়া দিতে পারে নি আজ ৩৩ বার গুড়িয়া নাটকটি নায়িকা মোনালিসার সাথে জুটি বেঁধে অভিনয় করার সুবাদে ওর প্রতি কেমন যেন একটা টান অনুভব করছি গুড়িয়ানাটকটিতে আমাদের নায়ক-নায়িকা হিসাবে নাকি দারুন মানিয়েছে, এটাও নাটকটির জনপ্রিয়তার একটা অন্যতম কারন মোনালিসা যখন আমার নাট্যগ্রুপে প্রথম এসেছিলো, সেইভাবে ওকে অতটা গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি গুড়িয়ানাটকটি মঞ্চস্থ করার কথা যখন আমি ভাবলাম, ওকেই আমি গুড়িয়ার চরিত্রে অভিনয় করতে বলি, আমাদের গ্রুপে আরো অনেক মহিলা অভিনেত্রী থাকা সত্ত্বেও জানিনা কেন, আমি ওকেই বলেছিলাম গুড়িয়া নাটকটি বিভিন্ন জায়গায় অভিনয় করেছি, সেখানে আমি আর মোনালিসাই নায়ক-নায়িকা হয়ে এসেছি সত্যি বলতে কি, নাটকের নায়িকা মোনালিসাই আমার স্বপ্নের গুড়িয়া আমার বলতে বাধা নেই, ওই আমার মনকে নাড়া দিয়েছে, চোখ বুঝলেই ওর মিষ্টি মুখটা আমার সামনে ভেসে ওঠে
ছলনা ভেবে ভালোবাসাকে, সরিয়েছি বহু দূরে
গুড়িয়া,
আজ তোমারই ছোঁয়ায় প্রেমের গান গেয়েছি নতুন সুরে  

(
)

 
গুড়িয়া আমার স্বপ্নকন্যা যাকে আমি স্বপ্নে বহুবার দেখেছি, যাকে মনে মনে খুব ভালোবেসেছি, সেই স্বপ্নকন্যাকে আজ আমি গুড়িয়ানাটকের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরেছি আমি, দিবাকর ঘোষ, আমার এই নাটকের নায়িকা মোনালিসা চক্রবর্তীকেই আমি গুড়িয়া রূপে খুঁজে পেয়েছি ভেবেছিলাম জীবনে গুড়িয়া আমার কাছে আর আসবে না মোনালিসাকে কে খুঁজে পেয়ে ভগবান সেই আশাকে বাস্তবায়িত করেছেন সবই ঠিক আছে, কিন্তু মোনালিসাকে আমি কি করে বলি, সে আমার স্বপ্নের গুড়িয়া ! অনেকবার চেষ্টা করেছি, বলতে পারিনি বেশ কয়েকবার আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েছি, মোনালিসা শুধু আমাকে দেখে বলেছে, ‘স্যার, কিছু বলবেন ?’… আমি ওর প্রশ্নের জবাব দিতে পারিনি মনের ভেতর থেকে কে যেন বলতো, ‘হ্যাঁ গুড়িয়া, অনেক কিছুই যে বলার আছে, তুমি কি কিছুই বুঝতে পারনা  এই ভাবে দিন কেটে যায় কিন্তু বলা আর হয় না  
হাওড়া শরৎ সদনে একটি নাট্যগোষ্ঠী পরিচালিত নাট্যোৎসবে আমার নাটক গুড়িয়াকে আমান্ত্রণ জানিয়েছে আমি ঠিক করেছি দর্শকের কাছে আমার গ্রুপের এটাই হবেগুড়িয়া শেষ পরিবেশন তাই গুড়িয়াকে আরো সুন্দর ভাবে তুলে ধরবার জন্য  জোরকদমে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল কিন্তু তারই মধ্যে আমার ব্যাকুলতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে কি করে যে আমি আমার মনের কথা মোনালিসাকে বলবো সেটা ভেবেই চলেছি কিন্তু বলা আর হয়ে ওঠে না, সেটা বাকি রয়ে যায় আস্তে আস্তেগুড়িয়ানাটকটির শেষ মঞ্চস্থ করার দিন চলে এলো শরৎ সদনের নাট্যোৎসবে আমার গুড়িয়াকে শেষ বারের মত দেখার জন্য অগণিত দর্শকের ভীড়, আমি তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই    
 নাটকটি আরম্ভ হওয়া থেকেই আমি কেমন যেন আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ি তারই প্রভাব নাটকের ওপর পড়লো নাটকটির শেষ দিকে নায়কের সাথে নায়িকা গুড়িয়ার মিল থাকবে না, এটাই স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী ছিলো গত ৩৩ টি শোতে সেটাই দেখানো হয়েছিল শেষ দৃশ্যে একটি আবেগঘন মুহুর্তে নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ব্যাপার ছিলো সেই আবেগঘন মুহুর্তটিকে আমি কেনো জানিনা নিজের মত করে নিলাম আমি গুড়িয়া রূপে মোনালিসাকে কিছুতেই দূরে সরিয়ে  দিতে চাই না হঠাৎ করে আমি বিপুল সংখ্যক দর্শকের মাঝে গুড়িয়া তথা মোনালিসাকে আমার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করি নাটকটির শেষ দিকে পূর্ব নির্ধারিত স্ক্রিপ্ট টিকে পরিবর্তন করে পুরোপুরি নিজের মত করে নিলাম গুড়িয়াকে নিজের ভালোবাসার কথা জানানো ছাড়াও একসাথে ঘর বাঁধার কথাও জানালাম গুড়িয়া মানে মোনালিসা তো একেবারে হতভম্ব এছাড়াও আমাদের গ্রুপের বাকি সদস্যরাও এই নাটকীয় পট পরিবর্তনে একেবারে অবাক যেহেতু আমিই নাটকটির পরিচালক, তাই সবারই অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না এমনকি নাটকটির শেষ দিকে গুড়িয়ার যে ডায়লগগুলো ছিলো, সেগুলোও আর বলা হলো না আমার আবেগপূর্ণ কথাগুলোই ডায়লগ হিসাবে নাটকটিকে একটা আলাদা মাত্রা দিয়ে দিলো, সেটা বুঝলাম তখন, যখন নাটক শেষ হয়ে যাওয়ার পর হলভর্তি দর্শকেরা হাততালি দিয়ে অভিভাদন জানাল সবাই আমার এই নাটকীয় পট পরিবর্তনের চর্চা শুরু করে দিলো নাটকটির হঠাৎ এই পরিবর্তনের সবাই খুব প্রশংসা করতে লাগলো তারই মাঝে আমি দেখলাম আমার গুড়িয়া মোনালিসা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর চোখের ভাষা দেখে মনে হলো, কি যেন বলতে চাইছে ………
 চঞ্চল  হৃদয়ের ছোট ঘরেতে কে যেন দেয় উঁকি
 
গুড়িয়া,
 
আমার হৃদয় খাতার প্রথম পাতায় এঁকেছিলে আঁকিবুকি


(
)

 
শরৎ সদনে আমার নাটক গুড়িয়া শেষ তথা ৩৪ তম মঞ্চস্থ হওয়ার পর বিপূল সংখ্যক জনতার করতালি আমাকে আমার গ্রুপের সবাইকে মোহিত করে দিয়েছিলো বিশেষ করে নাটকটির শেষদিকের হঠাৎ পরিবর্তনে নায়কের সাথে নায়িকা গুড়িয়ার মিল দেখতে পেয়ে দর্শকগণ খুবই উৎফুল্ল মনে মনে নিজেকে ভীষণ হাল্কা মনে হলো ভাবলাম আমার মনের সত্যি কথাটা এবার আমার গুড়িয়া, মোনালিসাকে বলেই ফেলি আশা করি অমৎ করবে না। এদিকে আমার পরিচয় পরিচালক দিবাকর ঘোষ তো ছিলোই, তার সাথে এই নাটকটির শেষ শো দেখার পর অভিনেতা দিবাকর ঘোষকে নিয়ে আগ্রহ অনেকেরই বেড়ে গেলো দর্শক বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠী থেকে গুড়িয়ানাটকটি আরও মঞ্চস্থ করার জন্য অনুরোধ আসতে লাগলো         
 ‘গুড়িয়ানাটকটির শেষ শো-এর পর মোনালিসা সেই যে চূপ হয়ে গেলো, তারপর থেকে আমার সাথে বেশি কথা বলে না নাটকটির শেষ দৃশ্যে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি আর বলেছি, ‘গুড়িয়া, তুমি আমাকে ছেড়ে যেওনা, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি এই না থাকা অংশটি নাটকটিতে হঠাৎই হয়ে যাওয়ায় মোনালিসা অবাক হয়ে শুধু চেয়েই থাকে, কিন্তু এই ব্যাপারে সে কিছুই বলে না ওর চুপ হয়ে থাকার মধ্যে আমি যেন অনেক কিছু খুঁজে পাচ্ছি, হয় আমাকে ভালোবাসে না হয় আমাকে এড়িয়ে চলছে আমার নিজেকে খুব দোষী মনে হতে লাগলো আমিই ওকে আশ্বস্ত করে জানালাম যে, গুড়িয়ার শেষ শো কে একটু বিশেষভাবে পরিবেশন করে সবাইকে চমক দিতে চেয়েছি তাতে মোনালিসা কতখানি সন্তুষ্ট হলো বোঝা গেলো না কিন্তু আমি ওকে আসল কারণটা কিছুতেই জানাতে পারলাম না, বরাবরের মত আবার তা বাকিই রয়ে গেলো
পরের সিজনে দর্শকের সামনে একটি নতুন নাটক পরিবেশন করতে হবে সেই অনুযায়ী আমারই রচনামোহিনীকে মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করে ফেললাম ঠিক করেছি, মোহিনীতেও মোনালিসা মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করবে মূলতঃ ওর কথা ভেবেই এই নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরী করে ফেললাম নায়কের ভূমিকায় নিজেকেই না হয় আর একবার ! আর এমনিতেও মোনালিসার বিপরীতে নিজেকে দেখতে খুবই ভালো লাগে তারপর কদিন ধরে যেভাবে আমাকে দেখছে তাতে আমার হৃৎপিন্ড কি ভাবে নাচানাচি করছে তা আর বলার নয় একদিন মোনালিসাকে ডেকে আমার নতুন নাটক মোহিনীর কথা জানালাম এবং এখানেও যে আমাদের জুটি অভিনয় করবে সেই ব্যাপারেও বললাম কিছুক্ষণ চূপ থাকার পর জানালো ওর পক্ষে আর আমার গ্রুপে থাকা সম্ভব নয়, সুতরাং পরের নাটকে ওর অভিনয় করা হবে না প্রবল হতাশা নিয়ে আমি ওর কাছ থেকে কারণটা জানতে চাইলাম কাঁপা কাঁপা গলায় জানালো, “স্যার, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, তাই কাল থেকে আমি আর আসতে পারবো না” … প্রখর সূর্যের আলোতেও কেমন যেন মনেতে অন্ধকার, চোখ থেকেও নিজেকে অন্ধ মনে হচ্ছে আমার চারপাশ থেকে মনে হচ্ছে হতাশা নামে একজন দানব আমাকে গ্রাস করে ফেলছে আমার গুড়িয়ামোনালিসা তার কথা বলে দিয়ে দেখলাম কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো একবারও জিজ্ঞেস করে গেলো না আমি কি নিয়ে থাকবো ? ওর চলে যাওয়ার দিকে আমি বোবা হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম …… 
  ভেবেছি, তোমার ছোঁয়ায় পূর্ণ হয়েছে শূন্য এই হিয়া… 
 
গুড়িয়া,
 
দমকা হাওয়ায় কোথায় গেলে ? নিভে গেল সব দিয়া

প্রকাশিত - দিগন্ত পত্রিকা, ২০১৫ শারদ সংখ্যা 

4 comments:

  1. দারুণ হয়েছে...শুরু আর শেষটা দারুণ...। সিনেম্যাটিক বলে মনে হলো কিছুটা...👌

    ReplyDelete