Monday, March 4, 2024

"পেয়েছি তোমায় খুঁজে" - পাঠ প্রতিক্রিয়া - সুদীপ্ত পারিয়াল

 


পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ- 

"পেয়েছি তোমায় খুঁজে"

লিখেছেন - রাজকুমার ঘোষ 

আমাদের পদক্ষেপ প্রকাশনী 

আলোচক - সুদীপ্ত পারিয়াল 

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বাকসাড়া তরুণ সংঘ লাইব্রেরির শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় অগ্রজ কবি ও গল্পকার রাজকুমার ঘোষের গল্পগ্রন্থ "পেয়েছি তোমায় খুঁজে" মুক্তির পথে এগিয়েছিল। দাদার থেকে বইটি উপহার পাওয়ার পর এক নিঃশ্বাসেই পুরো বইটি শেষ করেছিলাম। কিন্তু দাদার অনুরোধ ছিল রিভিউ লিখে দেওয়ার। একটু আশ্চর্যই লেগেছিল। এত বড় একজন কবি, সংগঠক, গল্পকার, সম্পাদক এবং সর্বোপরি একজন আদর্শ শিক্ষক আমার কাছ থেকে রিভিউ চাইছেন! আসলে রাজকুমারদা এমনই। দাদার মতন সহজ সরল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। রিভিউ লিখছি ঠিকই, তবে এটা সম্পূর্ণই একজন সাধারণ পাঠকের মতামত।

৮০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সব রকম প্রেমের অপূর্ব কোলাজ এঁকেছেন গল্পকার রাজকুমার ঘোষ। টক ঝাল মিষ্টি এই অনুভবের প্রকাশ তার সবকটি রচনাতেই খুঁজে পেয়েছি। বইটিতে তার পাঁচটি ছোটগল্প বা গল্প। একটি উপন্যাস রয়েছে।

সেই মেয়েটা

গল্পটি মনে করিয়ে দেয় পাঠকের কিশোর জীবনের কথা। কিশোর অবস্থায় প্রেমের চঞ্চলতা ও আবেগপ্রবণতা গল্পটির অজয় চরিত্রটিতে ফুটে উঠেছে। তবে দ্বন্দ্বের বুনট গল্পটিকে আরেকটু উন্নত করতে পারত বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।

খোলা চুলে আখ্যান

ব্যক্তিগতভাবে এই গল্পটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। কিশোর প্রেমের চাঞ্চল্য তথা এক সুমিষ্ট সম্পর্কের মিশ্রণ গল্পটি এক অন্য মাত্রায় উন্নত করেছে। এ গল্পের রেশ দীর্ঘক্ষণ মনে থেকে যায়। এমন গল্প অবচেতন মনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে।

সাইকেল ও অর্গানিক কেমিস্ট্রি

এই গল্পটি অত্যন্ত মজার। সেই সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের একটি ক্ষীণ প্রকাশ। মধ্যবিত্ত জীবনের দারিদ্রতা, ও বুঝিয়ে মেনে চলা, মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেরাই বোঝে। সেই সঙ্গে পূর্বপুরুষের স্মৃতি বহন। প্রেমিকার আদর অভ্যর্থনা, সব মিলিয়ে এই গল্পটি একটি সার্থক ছোটগল্প।

স্বপ্ননীল

রেখা চরিত্রটি বোধহয় আমাদের অন্তরের একটি চরিত্র। আমার মনে হয়েছে আমাদের সকলের সুপ্ত বাসনার মতন এমন একটি চরিত্র অন্তরে লুকিয়ে থাকে। যাদের ইচ্ছে করে অসুন্দরের প্রতি আসক্ত হতে। এই অসুন্দর বাহ্যিক আর সুন্দর নয়, অন্তর্নিহিত অসুন্দর। সেই আসক্তি অসুন্দরকে সুন্দরতর করে তোলার চেষ্টায় রত থাকে সারাক্ষণ। এই আত্মনিবেদন আজকের দিনে খুব একটা দেখা যায় না। সমাজ যখন অবনমনের পথে তখন এই ধরনের একটি গল্প নিছক প্রেমের গল্প নয়, সামাজিক ও শিক্ষণীয় গল্পও বটে। গল্পটি বারবার পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়। তবে সিনেম্যাটিক কায়দায় সমাপ্তি না টেনে, গল্পকার এ গল্পের শেষ অংশটা পাঠকদের ভাবার জন্য ছেড়ে দিতে পারতেন।

স্বীকৃতি

এই গল্পটি মানবিক সম্পর্কের পাশাপাশি, সমাজের কিছু শ্রেণীর মানুষের বক্রদৃষ্টির প্রকাশ। তার বিরুদ্ধে গর্জন করেছে মানবিক সম্পর্ক। শুক্লা ও মহাদেবের প্রেম থাকুক বা নাই থাকুক। ওদের যে মানবিক বন্ধন তাই যেন ওদের প্রেমের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তার থেকেও বড় কথা মানবিক সম্পর্কে প্রতি সকলের দায়বদ্ধতার কথা লেখক যেন এই গল্পটির মাধ্যমে সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন।

উপন্যাস-পেয়েছি তোমায় খুঁজে

একটি মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস "পেয়েছি তোমায় খুঁজে"। কিশোর যুবক তথা সকল বয়সের মানুষের জন্যই সহজ সরল ভাষায় লেখা একটি পরিচ্ছন্ন উপন্যাস। জটিলতা বা দ্বন্দ্ব বা কোন কঠিন শব্দ চয়নও খুব একটা চোখে পড়ে না। এক কথায় বলতে গেলে উপন্যাসটি মনের মধ্যে গেঁথে যায়। তবে রিভিউ করতে বসে, শুধু ভালো দিকগুলোই বলবো! যেগুলো একটু ত্রুটি মনে হল সেগুলোও একটু বলার চেষ্টা করছি। অজান্তে লেখকের মনে আঘাত দিলে আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি।

প্রথমেই বলি আমি জানি না উপন্যাসটি লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা কিনা! সাধারণ পাঠক হিসেবে এটা জানবার কোন প্রয়োজন বোধ হয় না। শুধুমাত্র গল্প পড়ার আনন্দে উপন্যাসটি পড়েছি। তবে উপন্যাসের প্রথম শর্ত সংলাপ ও লেখকের বক্তব্যের ভিন্নধর্মিতা। সেই জায়গাতে কোথাও যেন এক হয়ে গেছে এই উপন্যাসটি। এটি যেমন এক ক্ষেত্রে ভালো দিক। আবার কখনও কোন ঋদ্ধ পাঠক যখন পড়বেন তখন তার মনে হতেই পারে যে চরিত্রের বলা সংলাপ অর্থাৎ কথিত সংলাপ ইংরেজিতে যাকে বলে কলোকয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ, তার প্রয়োগ সব জায়গায় সমান চোখে পড়ল না। একটি উদাহরণ দিই,

রেখাপাত, প্রতিকূল ইত্যাদি শব্দ বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে সংলাপ নির্মাণের ক্ষেত্রে। আরও একটি কথা, রাজেনের বয়স আন্দাজে তার সংলাপ অনেক শিশুসুলভ। একইভাবে প্রায় প্রতিটি চরিত্রেরই সংলাপ নির্মাণ খুব একটা আলাদা করা যায় না। বয়সের ভিন্নতা অনুযায়ী সংলাপের ধরন পাল্টালে উপন্যাসটি আরও একটু সমৃদ্ধ হতো।

দ্বিতীয়তঃ লেখকের বক্তব্য, লেখকের ব্যাখ্যায়

'ফাটাফাটি', 'ভীষণ ভালো' , প্রভৃতি শব্দ একটু কানে লাগে। এর বিকল্প ভাবা যেতে পারে। আর 'ভীষণ ভালো' শব্দটির ক্ষেত্রে, ব্যাকরণগত ভুল আছে। ভুলের কথা অধিকাংশ বাংলা সাহিত্যিকরাই জানেন না। ভীষণ শব্দটি নেতিবাচক। সুতরাং কোনও নেতিবাচক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা এই শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। যেমন ভীষণ ঝড় উঠেছে,আমার ভীষণ বিপদ ইত্যাদি। কিন্তু কোন ইতিবাচক কথা বা ঘটনার ক্ষেত্রে ভীষণ শব্দটি প্রয়োগ করলে সেটি ব্যাকরণগতভাবে ভুল হয়। এই নিয়মটি অধিকাংশ লেখকরাই মান্য করেন না। এক্ষেত্রে একটু নজর দিলে মনে হয় ভালো হয়। 'আগামীদিন' শব্দটিও ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ নয়। 'আগামী দিন' শুদ্ধ। যদি আগামীদিন লিখি তাহলে 'মী' না লিখে 'মি' লিখতে হবে। অর্থাৎ আগামিদিন। মত শব্দের পরিবর্তে মতো বা মতন লিখলে নির্ভুল হবে।

এবার উপন্যাসের বর্ণিত কিছু ঘটনা সমূহের ব্যক্তিগত মন্দলাগা বা ভালোলাগা নিয়ে বলতে চাই।

পাত্রী দেখা

যদি ঘটনাটি আজ থেকে কুড়ি- ত্রিশ বছর আগেরকার হয়, তাহলে গায়ত্রী ক্ষেত্রে পাত্রী দেখার নিয়মটি ঠিক আছে। কিন্তু আধুনিক সমাজে লেখকের দায়িত্ব অনুযায়ী পাত্রী দেখার বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখককে একটু ভাবতে অনুরোধ জানাই। তবে উপন্যাসে গায়িত্রী চরিত্রটি যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে আমার মনে হয়েছে, নায়িকা সুলভ সমস্ত গুণই তার মধ্যে বর্তমান। কিন্তু তার বাহ্যিক কোন বর্ণনা দেওয়া হয়নি। আর হলেও আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে হয়তো। শুধুমাত্র গায়ের রং কালো বলে রাজনের মা, যে নিজেও একজন নারী সে একটি মেয়েকে নিজের সুপুরুষ সন্তানের জন্য বাতিল করে দিল এটা একটু ভাবায়! তাহলে মায়ের চরিত্রটিরও নির্মাণ প্রসঙ্গে আরও একটু দ্বন্দ্ব প্রয়োজন।

রুপালি চরিত্রটি নির্মাণ

প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দুটি দিক থাকে। মুখ ও মুখোশ। রুপালি যেন শুধু মুখই। তার কোন মুখোশ নেই। সে যখন প্রকাশ্যেই রাজেনকে জানাচ্ছে সে অনেক পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করে, তখন রাজেনের কি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়,  অনেক পুরুষের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক থাকতে পারে! চরিত্রটির কোনও ইতিবাচক দিক দেখানো হয়নি। 

তুলি চরিত্রটি নির্মাণ

রাজেনের জীবনে যে কটি নারী চরিত্র এসেছে, তার মধ্যে তুলি চরিত্রটি সবথেকে সুন্দর বলে আমার মনে হয়। আসলে উপন্যাসটি পুরোপুরি রাজেনকেন্দ্রিক। তাই অন্যান্য চরিত্রগুলির মানবিক বিশ্লেষণ করা হয়নি। তুলির মানবিক বিশ্লেষণ করা হলে বোঝা যায়, তার কথাগুলি খুবই বাস্তবসম্মত। হয়তো তার মধ্যে শারীরিক চাহিদার স্পৃহা জাগিয়ে, তাকে নেতিবাচক করা হয়েছে। তবে রাজনের প্রথম প্রেম তুলি আমার কাছে তার কাছে শ্রেষ্ঠ প্রেম।

হয়তো অনেক বেশি বলে ফেললাম। তবে পাঠক হিসেবে একদম সততার সঙ্গে সবকিছুই বললাম। অভিনন্দন জানাই লেখক রাজকুমার ঘোষকে।


 

Friday, June 16, 2023

ভৌতিক গল্পঃ মাঝরাতে হাতছানি

 


মাঝরাতে হাতছানি
রাজকুমার ঘোষ

স্বপ্ননীল ঘোষ, লেখক হিসাবে বেশ নাম ডাক হয়েছে। বেশ কয়েকটি উপন্যাস, গল্প এমনকি কাব্যগ্রন্থ পাঠক মহলে বেশ সাড়া ফেলেছে। তবে সবই প্রেম, বিরহ, বেদনা, সামাজিক, পারিবারিক বিষয় নিয়ে লেখা। খুব জোর সাসপেন্স থ্রিলার নিয়ে তিন-চারটে গল্প লিখেছেন। কিছুদিন যাবৎ একটি প্রকাশনা সংস্থা তাদের ভৌতিক সংকলনের জন্য ওনার থেকে ভৌতিক ব্যাপার নিয়ে লেখা চেয়েছে। সংকলনের নামকরণ হবে “মাঝরাতের হাতছানি”। স্বপ্ননীলবাবু বেশ ফাঁপড়ে পড়ে গেলেন। প্রকশনী সংস্থা থেকে জোর অনুরোধ এসেছে একটা গল্প লিখতেই হবে। আগের সকল সংকলনে ওনার লেখা ছিল। কাজেই এবারেও ভূত নিয়ে তাদের লেখা চাই...চাই।
কিন্তু লেখক মহাশয় সেভাবে ভূতের গল্প কোনোকালেই লেখেননি। বলা ভালো অপার্থিব বিষয় নিয়ে ওনার লেখা আসে না। তবে ভূতের গল্প পড়েছেন বা সিনেমাও দেখেছেন, হয়তো ভয়ও পেয়েছেন। আবার খুব যে পেয়েছেন তাও না। কিন্তু ভূতের গল্প লিখতে গিয়ে কিছুতেই লেখা আসেনা। সম্পাদকের উপর রাগ দেখিয়ে মনে মনে বললেন,
“বেছে বেছে যত ফালতু বিষয়বস্তু। সম্পাদক পারেও বটে। বলে কিনা পাবলিক ডিমান্ড”
সম্পাদকের আজ্ঞবহ হয়ে যথারীতি ভূতের গল্প লেখার জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছেন। একে একে গা ছমছম করা বনে বাদাড়ে, নিঃশব্দ, নিঃস্তব্ধ গ্রামের মধ্যে পোড়ো বাড়ি থাকলে সেখানেও গিয়েছেন, এমনকি বেশ কিছু মন্দিরে পুজো দিয়েছেন যাতে করে জম্পেশ দু-চারটে ভূতের গল্প লিখতে পারেন। তবুও একটা ভূতের গল্প এল না। শুধু মানুষ ভূতের কথা লেখায় চলে আসে। নিজের উপর স্বপ্ননীলবাবুর বিরক্তি চলে আসছে। এমনকি গতকাল রাত দু’টো পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন কিন্তু না, ভূত নিয়ে একটা শব্দও আসেনি। মনে মনে বললেন,
“দূর ছাই, আর লিখবো না। সম্পাদক যা বলার বলবে, রাগ করলে করবে। যাই, ভালো করে ঘুমোতে যাই। তার চেয়ে আগামীকাল সকাল থেকে আমি আমার স্বাভাবিক সত্ত্বায় ফিরে আসব। কবিতা এবং ছোট-বড় বিভিন্নরকম গল্প নিয়েই না হয় আমি নিজের ছন্দে নিমজ্জিত থাকব। এইসব অবাস্তব বিষয় একদম না!”
এরপর স্বপ্ননীলবাবু স্টাডি রুমের লাইট নিভিয়ে বাড়ির দোতলায় শোবার ঘরে যাবার আগে একটু বাথরুমেও ঘুরে এলেন, হ্যাঁ অবশ্যই অন্ধকারে, তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাড়ির ছাদেও গেলেন। বাড়ির ছাদের আকাশ আজ যেন ঘন কালো। কিছুদিন আগে কালীপুজো চলে গেছে। জগদ্ধাত্রী পুজোও কেটে গেছে। বেশ শীতের আমেজ আসছে। গায়ে একটা পাতলা জামা পড়ে আছেন। ছাদের আশেপাশে ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারকেই ভেবে নিলেন একটা ছায়ামূর্তি যেন ওৎ পেতে বসে আছে ওনাকে ভয় দেখাবে বলে। সিনেমায় দেখা একটা ভৌতিক মুখ কাল্পনিক ভাবে ওনার মনে ছকে নিয়ে নিজের মনেই বললেন,
“কিরে ভূত, আমার ঘাড় মটকাবি নাকি? সাহস থাকলে সামনে আয় দেখি, কেমন তোর সাহস?”
কিন্তু অসফল প্রচেষ্টা। তেনাদের কারোর দেখা নেই। ভাবলেন তেনাদের কোনো প্রতিনিধি এসে একটা ভূতের গল্প লেখার প্লট দেবে। এরপর নিজের অজান্তেই ছাদের একটা ধারে দাঁড়িয়ে বেশ দূরে একটা পোড়ো বাড়ি আছে, সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন। যেখানে দীর্ঘদিন কেউ বাস করেনি। ছোটবেলায় লুকোচুরি খেলার সময় সেই বাড়িতে গিয়ে অনেকবার লুকিয়েছেন। সেই বাড়ির দিকে তাকিয়েই উনি টাটা করে হাঁকলেন,
“টাটা গো অন্ধকারের মানুষজন, পারলে আমাকে ভয় দেখাও দেখি! যদি কিছু মনের মধ্যে গল্প চলে আসে। আর তাও যদি তোমার সম্মানে লাগে। কাছে এসে ঘাড় মটকিয়ে দেখাও দেখি!”
কিন্তু কোথায় কি? স্বপ্ননীলবাবু হতাশ হয়ে কালো অন্ধকারে হাতরে হাতরে নিজের শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। তারপর ঘরের কম পাওয়ারের লাইট জ্বেলে অভ্যাসবশত বিছানার পেছনের দিকে রাখা আয়নায় নিজের মুখমন্ডলটি দর্শন করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। কিন্তু হঠাৎই তার মনে হলো,
“সত্যি তো! আয়নায় আমি কী দেখলাম? আমি কি আমার মুখের অবয়ব সত্যি কি দেখতে পেলাম!”
এবার কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করলেন। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। না চাইলেও একটু একটু ভয় পেতে থাকলেন। ওনার মনে হলো,
“আয়নার যখন নিজের মুখ দেখতে গেলাম, কিছুই দেখতে পেলাম না। কি জানি, মনের ভুল হবে বোধ হয়”
হালকা গা শিরশিরানি শীতেও ওনার গায়ে বেশ ঘাম চলে এল। জল পান করতে গিয়ে জলের বোতলটি তুলতে গিয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই তুলতে পারছেন না। বোতলটি তোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা!
“কি হলো আমার সাথে? কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সব মাঝরাতের হাতছানি নাকি। এমন তো কোনোদিন হয়নি। ভূতের গল্প লেখা মাথায় থাক বাবা... আর নয়। অনেক হয়েছে”
স্বপ্ননীলবাবুর শিড়দাঁড়া দিয়ে যেন হালকা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন বিকল হয়ে যাচ্ছে। উনি ঘরের লাইট জ্বালাতে গেলেন। কিন্তু কেমন যেন দুর্বল লাগলো। সামান্য সুইচও অন করতে পারছেন না!
“হলো কী আমার?” নিজের মনেই জিজ্ঞেস করে অনুভব করলেন নিজের হৃদস্পন্দনের মৃদু আওয়াজ হঠাৎ শব্দ সহকারে কানের মধ্যে প্রবেশ করছে। উনি ভয়ে কানে হাত দিয়ে দিলেন। এদিক ওদিক ভাবতে ভাবতে পরিশেষে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লেন, মনে হলো ওনার লাশটা ঝুপ করে আওয়াজ করে টলে পড়ল বিছানায়। চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা বনবন করে কি যেন ঘুরতে থাকা চাকতির মতো, তীক্ষ্ম শব্দে ওনার মাথাকে আরও ভারী করে দিচ্ছে। ওনার কিছুই ভালো লাগছে না। শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হছে। এরপর আচ্ছন্ন হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লেন।
কিন্তু এক ঘন্টা পর ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গিয়ে ওনার মনে হলো বাড়ির লোকজনের ভয়ার্ত গলা। বেশ শোরগোল। সবাই কেন চেল্লাচ্ছে বুঝতে পারছেন না। ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির নিচে চলে এলেন ওনার স্টাডি রুমের কাছে। দেখলেন, বাড়ির সবাই সেই ঘরে হাজির। বেশ কিছু প্রতিবেশীও এসেছে। সবাইকে কাঁদতে দেখে ভীষণ চিন্তিত হয়ে বাড়ির অন্যঘর গুলো দেখলেন। সেই ঘরগুলোয় কেউ নেই। বাবা-মা’কে দেখতে না পেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। আবার স্টাডি রুমে ফিরে এসে দেখলেন বাবা-মা কাঁদছেন। তাহলে কার কি হল? সকলে কাঁদছে কেন? অবাক করার মত ব্যাপার, কাউকে ঠেলতে হলো না। স্বপ্ননীলবাবু সবাইকে ভেদ করে স্টাডি রুমের মধ্যে এসে একটু উঁকি দিতেই ওনার চক্ষু চড়ক গাছ! মনে মনে বললেন,
“একি দেখছি আমি?”
ওনার গা হাত পা ঠান্ডা হওয়ার উপক্রম। দেখলেন, ওনার নিস্তেজ দেহটা পড়ে আছে স্টাডি রুমের ঘরে। আর সেই দেহটি আঁকড়ে ধরে আছে ওনার বোন। ডাক্তার নাকি আগেই এসে দেখে গেছে। সকলের বলাবলিতে জানতে পারলেন, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে ওনার মৃত্যু ঘটেছে।
সমস্ত ব্যাপারটা প্রত্যাশিত না, কাজেই এমন একটা মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে ওনার মাথাটা কেমন যেন বনবন করে ঘুরতে লাগল। স্বপ্ননীলবাবুর এবার বেশ ভয় ভয় করছে। নিজেকে বেশ অসহায় মনে হচ্ছে। সামান্য ভূতের গল্পই তো লিখতে চেয়েছিলেন উনি। তার পরিণতি এমন ভয়াবহ হবে তা কল্পনার বাইরে। ঠিক এমন সময় দূর থেকে একটা বজ্র কঠিন চাপা গলায় এক ছায়ামূর্তি কোথা থেকে ওনার দিকে ধেয়ে এসে বলল,
“আমাদের দুনিয়ায় মাঝরাতের হাতছানিতে সুস্বাগতম লেখক। আপনার আমন্ত্রণ না রাখতে পারলেও আশা করি আমাদের আমন্ত্রণ আপনি নিশ্চয়ই রাখবেন”
সমাপ্ত

Tuesday, August 30, 2022

পাঁচ-এ পঞ্চবাণ- কাশফুল 

 


পাঁচ- পঞ্চবাণ-

কাশফুল 

রাজকুমার ঘোষ ~ ৩০..২২

 

ভোরের সূর্যের মৃদু আলোর পরশে

বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মধুর হরষে

জানান দিয়েছে মাগো তোমার আগমন

কাশফুলের বাহারে আনন্দে মাতে মন।

শুভ হোক প্রকৃতির নতুন বরষে।

-------------------------

পাঁচে পঞ্চবাণ--

বৃষ্টির ছাঁট

রাজকুমার ঘোষ ~ ২৩..২০২২

 

মন জুড়ানো এলোমেলো বৃষ্টির ছাঁট

স্মৃতির উৎস মধুর মিলনের সাথ

চাওয়া পাওয়ার হিসেব ক্ষুদ্র অতি

জীবনের চলাতে হবে তো গতি

বৃষ্টির ধারাপাতে দৃঢ় বাঁধা দু'হাত...

-------------------------------

পাঁচে পঞ্চবাণ-

কথার ধার

রাজকুমার ঘোষ ~ ২৩..২০২২

 

কিছু কথার আবহে কষ্টের আধার

বক্তার বলাতে রয়েছে ছুরির ধার

ক্ষতবিক্ষত মন যায় নাতো দেখা

অদৃশ্য রক্তপাত যেন গোপন লেখা

হৃদয়ের খাতায় অজস্র শব্দের বাহার

-------------------------------------------

পাঁচ- পঞ্চবাণ-

সামাজিক নয়

রাজকুমার ঘোষ

 

হিসাবের খাতায় পাবেনা কোনো খোঁজ

মোচ্ছব ফুর্তি সাথে অফুরান মহাভোজ

প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত মন

স্রোতের প্রতিকূলে সামাজিক হবে কখন?

কঠিন সংগ্রাম করে লড়ছে হররোজ।।

-------------------------------

পাঁচ- পঞ্চবাণ-

প্রেমপত্র

রাজকুমার ঘোষ ~ ২৫..২২


চোখটি তুলে তাকে প্রথমবারের দেখা

মনের কোণে ভালোলাগার রঙিন রেখা

উতলা হয়ে ওঠে ব্যকুল হৃদয়

কিভাবে জানাবে তাকে? মনে সংশয়

অবশেষে প্রেমপত্র, প্রথম হল লেখা।

---------------------------


Monday, August 29, 2022

অণুগল্পঃ- পটলার "অবলা" প্রেম

 

~ রাজকুমার ঘোষ - ২৯.০৮.২০২২

বেশ সুন্দর করে পটলা জীবনটা একটু গুছিয়ে নিয়েছিল। একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেয়ারার চাকরি পেয়ে রোজের সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা ডিউটি করে বাড়ি ফেরা। তারপর... না আড্ডা নয়। পটলা আড্ডা দেওয়া পছন্দ করে না। পটলার ফেভারিট টিভি সিরিয়াল৷ বাংলা সিরিয়াল পটলার খুব প্রিয়। বিশেষ করে নতুন একটি সিরিয়াল চালু হয়েছিল, "মিস অবলা"। সেই সিরিয়ালের মুখ্য ভূমিকায় থাকা নায়িকা প্রীতিকা মিত্র পটলার ভীষণ ফেভারিট। প্রীতিকাকে নিয়ে ভাবতেই ওর খুব ভালো লাগে। মনে মনে মিস অবলাকে নিজের বৌ ভেবে ফেলেছে অবিবাহিত পটলা। ওর বাবা-মা বিয়ে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পটলা বলেছে ও অবলার জন্যই অপেক্ষা করবে৷ এমন পাগলামিতে ওর বাবা-মা ভীষণ বিরক্ত। এই ভাবনা নিয়ে পটলা থাকে সর্বক্ষণ। নিত্যদিন ভিড়বাসেই পটলাকে অফিসে যাতায়াত করতে হয়। অনেক যাত্রী ভিড় বাসে যেতে যেতে অনেক রকম বিরক্তি প্রকাশ করে, কিন্তু অবলার স্বপ্নে বিভোর পটলার ডোন্ট ওরি মনোভাব। ওর মনে হয় ওকেও অবলা থুড়ি প্রীতিকা ভালোবাসে৷ এই ভাবাতেই ওর যেন স্বর্গসুখ। ভিড়বাসে পটলার পা'টা কেউ বুট চাপা দিয়ে থাকলেও পটলা সহ্য করে নেয় প্রীতিকার বিভোরতায়। উলটে সে সেই যাত্রীকে বলে, "না না, আমি কিছু মনে করিনি। এমন ভিড় বাসে হতেই পারে।" সেই যাত্রীর রিপ্লাই আসে, "আপনি মনে করলেও কিছু যায় আসে না। কে একেবারে হরিদাস পাল!"৷ পটলা আর কথা বাড়ায় না। এইভাবেই চলতে থাকে। কিন্তু গত চার-পাঁচ দিন পটলার মন ভীষণ খারাপ৷ বড় খবর এখন মিডিয়া জুড়ে, 'অভিনেত্রী প্রীতিকা মিত্র'র মৃত্যু।" তারপর থেকে পটলার দিনগুলো কেমন যেন অসহায়। শুধুই অবলাকে দেখতে পায়। ওর শুধু মনে হয় প্রীতিকা ওর সাথেই আছে। খবর কাগজের প্রথম পাতায় প্রীতিকার ছবি দিয়ে মর্মান্তিক খবর প্রকাশিত হয়েছে। অফিসের ব্যাগে সেই পাতাটা পটলা সঙ্গে নিয়ে রেখেছে। আর মনে মনে নিজের বৌকে হারিয়েছে ভেবে উদাস হয়ে থাকে। কারোর সাথে কথা বলে না। বাড়িতেও সে তার বাবা-মা'র সাথে কথা বলে না। আগের মত টিভিতে সিরিয়ালও দেখে না। কিন্তু জীবন চলতে থাকে। পটলাও তার রোজদিনের অফিসে যায়। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত ডিউটি। ভিড় বাসেই যায়-আসে। এরমধ্যেই কোনো একটা দিন পটলা ভিড় বাসে উঠেছে। অতি কষ্টে একটা সিটও পেয়ে বসেছে। --------  

ওর কেমন যেন মনে হয় ওকে কেউ অনুসরণ করছে। কদিন ধরে এই ব্যাপারটা আরও বেশী করে মনে হচ্ছে। ভিড় বাসে উঠে সিটে বসে আছে, এতো কোলাহল, এতো শব্দ। তারই মধ্যে কে যেন ওকে ডাকছে। ও শুধু তার কথাই যেন শুনতে পাচ্ছে। "পটলা ... ও পটলা... তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না... তুমি আমাকে কত ভালোবাসো... আমিও তো তোমাকে কত ভালোবাসি... একবার তাকাও আমার দিকে... আই লাভ ইউ পটলা"। পটলার মনে হলো, এ কন্ঠ তো অবলার থুড়ি প্রীতিকার। সে সপ্তাহ খানেক হলো মারা গেছে। তার মিষ্টি কন্ঠ সে কি করে শুনতে পাচ্ছে। বেশ ভয় পেয়ে গেল পটলা। তেষ্টায় ব্যাগের মধ্যে থেকে জলের বোতল বের করার সময় সে দেখতে পেল, যে কাগজটির প্রথম পাতায় প্রীতিকার ছবি দিয়ে মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্রীতিকার ছবিটা যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সেখান থেকেই প্রীতিকা পটলাকে অনবরত জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে আর বলছে, "আই লাভ ইউ পটলা"... দেখা মাত্রই পটলা আঁতকে উঠল। এমন ভিড় বাসেও পটলা চিৎকার করে উঠল, "ভূত... ভূত... প্রীতিকার ভূত... আমাকে বাঁচাও। না আমি তোমাকে ভালোবাসি না"...

  ------- আরে কি হলো মশাই, কোথায় ভুত। এই দিনের বেলায় ভিড় বাসে ভূত কোথায় দেখতে পেলেন? অদ্ভুত মানুষ তো। এই ভিড়ে সিটের মধ্যে ঝিমুচ্ছে আবার স্বপ্নও দেখছে। আবার কাকে নিয়ে! প্রীতিকাকে নিয়ে... যত্তসব পাবলিক  

পটলা বাসের মধ্যে সিট পেয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আর স্বপ্নে প্রীতিকাকে দেখে যাতা অবস্থা। ভিড় বাসের মধ্যে অজস্র লোকের ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ওকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে বলাই বাহুল্য। যথারীতি ওর গন্তব্য চলে এলো। কারোর দিকে না তাকিয়ে ও মাথা নিচু করে বাস থেকে নেমে গেল। অফিসের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাগ থেকে সেই কাগজের প্রথম পাতাটা ছিঁড়ে রাস্তার মধ্যে থাকা ডাস্টবিনে ফেলে দিল  


Saturday, August 27, 2022

বড়গল্পঃ- শিকড়



রাজকুমার ঘোষ 

অনেক পুরোনো মধুর স্মৃতি নিয়ে প্রায় এক যুগ পর গ্রামে আসছে ডাঃ সাগর চট্টোপাধ্যায়। শিকড়ের টান যে তাকে বারেবারে হাতছানি দেয়নি তা নয়, সে তো আসতে চায় তার ছোটবেলায় কাটিয়ে যাওয়া এই হরিশপুর গ্রামে। তাদের রাজকীয় বসতবাড়ী, তার সাথে সংলগ্ন সবুজে ঘেরা গ্রাম্য জগৎ, চারিপাশে যেদিকে তাকায় ধান, সরিষার ক্ষেত, দু তিনটে পুকুর, ঠাকুর দালান এবং সর্বোপরি তার বাল্যবন্ধুদের সাথে কত আড্ডা... আজ শুধু স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করছে। গ্রামের রাস্তা ধরে তার বিলাস বহুল গাড়িটা যখন তাদের বসত বাড়ির দিকে ঢুকছে, সকলে অবাক পাণে তাকিয়ে রয়েছে... ছোট ছোট ছেলেগুলো হৈ হৈ করে গাড়িটির পেছনে ছুটে চলেছে। সাগর নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, তার পাশে থাকা স্ত্রী রমা ও ছেলে রকিকে তার গ্রামের কথা মুগ্ধ নয়নে বলে চলেছে। বাড়ির সামনে আসা মাত্রই সাগরের ছোটকাকা নারায়নবাবু বেড়িয়ে এলেন, তার সাথে ছিল তার ছোটবেলার দুই বন্ধু শিবেশ ও উমাপতি। সাগর এদের সাথে তার স্ত্রী ও ছেলের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
দুপুরে খাওয়া শেষে সাগর দুই বন্ধু শিবেশ ও উমাপতিকে নিয়ে বসলেন বাড়ির বৈঠক খানায়, যেখানে বসে একসময় দাদু, বাবা কাকারা গ্রামের উন্নয়নের জন্য গ্রামের লোকেদের সাথে কথা বলতেন। সেখানে বসে ওরা ওদের ছোটবেলায় ফিরে গেলেন নিমেষে। একে একে তারা বলতে লাগল স্কুলে যাবার সময় পুকুর পাড়ে বসে মাছ ধরা... ডাংগুলির ম্যাচ, এর ওর গাছে ভালো কিছু ফল পেলেই সেগুলো নিজের করে নেওয়া এবং পুজো পার্বনগুলোয় একসাথে চুটিয়ে আড্ডা... মেলায় যাওয়া, কতরকম খাওয়া-দাওয়া এবং খেলা কেনা সবকিছু। এতকিছুর মধ্যেও সাগর ভোলেনি সেইসময় গ্রামের খুবই পুরোনো লোক হরিদাদুর কথা, এই দাদুর সাথে ওদের সম্পর্ক খুবই নিবিড় ... যাকে বলে আদা-কাঁচকলায়... সেই সময় সাগরের পয়লা নম্বর শত্রু ছিল এই হরিদাদু... সেই প্রসঙ্গেই সাগর শিবেশকে
- হরিদাদুর কথা কিন্তু আমি এখনো ভুলিনি
- তোর হরিবুড়োর কথা মনে আছে?
- মনে আবার থাকবে না? ছোটবেলার চরম শত্রুকে কেউ ভোলে? দাদুর কি খবর?
উমাপতি বলে
- হরিদাদুর ছেলেপুলে তো কেউ ছিলো না। দুই মেয়ের বিয়ে তো সে কোন কালে হয়ে গেছে? শেষ বয়সে পাগল হয়ে যায়। দেখার কেউ ছিলো না, তোর বাবাই সেই দায়িত্ব নেয়। ওনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন। ওনার সম্পত্তি ওনার আত্মীয়রা এসে কোনো একজনকে বিক্রি করে দেয়।
সাগর খেয়াল করেছে হরিদাদুর বসতবাড়ীটা বেশ সাজানো গোছানো। ওর মনে আছে বাড়ির বাগানে আমগাছগুলো ছিলো, ভালো আম হত সেখানে, ওরা সেই আমগুলো গাছে উঠে পেড়ে নিতো। পেয়ারাগাছ গুলোতে বেশ ডাঁসা পেয়ারা থাকতো। একদিন দাদুর হাতে সাগর ধরা পরে গিয়েছিলো। ওর বাবাকে দাদু নালিশ করেছিলো এবং তার জন্যে বেধরক ঠ্যাঙানি দিয়েছিলো। তা মনে করেই সাগর
- মনে আছে বাবাকে নালিশ করে দাদু আমাকে ঠ্যাঙানি খাইয়েছিল।
শিবেশ বলল- সে আবার মনে থাকবে না? তারপর বদলা নেবার প্ল্যান কেমন নিলাম এবং সফলও হলাম।
এইসময় রমা প্রবেশ করল হাতে চা এর ট্রে নিয়ে
বদলা! কার জন্য বদলা আর কিসের প্ল্যান!
- বৌদি, ছোটবেলার স্মৃতিচারণ... সে এক দিন ছিল, আমরা তিনজন সেইদিন গুলোর কথা মনে করছি।
- তা আমাকেও কি বলা যায় না?
উমাপতি বলল-
নিশ্চয়ই, শুনুন তবে.........
তখন সাগর আর ওর বন্ধুরা মিলে পাশের বাড়ির হরিদাদুর বাগানের গাছ থেকে আম, পেয়াড়া চুরি করতে গিয়ে একদিন হরিদাদুর হাতে ধরা পড়ে গেলো। হরিদাদু সাগরের বাবাকে নালিশ করাতে ওর বাবা সেদিন ওকে প্রচন্ড ঠাঙানি দিয়েছিল। সাগর তারই বদলা নিয়েছিল।
সেইসময় প্রতিদিন ভোরবেলায় দাদু বাগান সংলগ্ন পুকুরে স্নান করতো, স্নান করার পর সূর্য প্রণাম করত। দাদু তার আন্ডার প্যান্টটা রাখতো পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে, সেই সুযোগটা সাগররা কাজে লাগিয়েছিল। সাগর বেছে বেছে অনেক কাঠ পিঁপড়ে যোগাড় করেছিল। কোন একটা দিন দাদু যখন পুকুরের জলে ডুব দিয়ে উঠে সূর্য প্রণাম করছিল, ঠিক সেইসময় ও গোটা দশেক পিঁপড়ে দাদুর আন্ডার প্যাণ্টের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ব্যাস তারপর দেখে কে! স্নান করার পর দাদু তার আন্ডারপ্যান্ট পড়ল, কিছুক্ষণ পরেই দাদুর ভয়ংকর রকম লাফালাফি শুরু, দাদু কোনরকমে প্যান্টটা ছেড়ে সাগরের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিল তারপর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এরপর সাগরের বাবা দাদুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। দাদু প্রায় পাঁচদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি। পরে জেনেছিল ব্যাপারটা কি, এবং সাগরকে ওর বাবা তার উপযুক্ত শাস্তিও দিয়েছিলেন।
রমা সাগরের দিকে তাকিয়ে- তুমি এতটা দুষ্টু ছিলে? ভাবা যায় না। এখন রকিকে শাসন কর... সত্যি! ভাগ্যিস এখানে এলাম তাই জানতে পারলাম।
- বৌদি আরো আছে... অবাক হওয়ার কিছুই নেই। - উমাপতি বলা শুরু করল...
এরপর সাগর শাস্তি পেয়ে শান্ত একদমই হলো না বরং ও আরো বেশী জেদী হয়ে গেল। রাগে ও আরো ভয়ংকর কিছু প্ল্যান করতে লাগলো এবং তা করে ফেললো। ও গ্রামের হাট থেকে লঙ্কা গুড়ো নিয়ে এলো। দাদু নস্যি নিতো, একদিন দাদুর বাড়িতে গিয়ে নস্যির ডিব্বার মধ্যে লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে দিল। দাদু যেই নস্যি নাকে নিয়েছে, আর দেখতে নেই, হেঁচে হেঁচে তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো এবং তার নাক ফুলে ঢোল হয়ে গেল। প্রায় সপ্তাহ খানেক দাদু বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেনি। সাগরের বাবা এরপর ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সাগর রাগে ওর মামাবাড়ি চলে গেল। প্রায় চার মাস পর কালিপুজোর আগে ওর বাবাই ওকে নিয়ে আসে।
কালীপুজোর পর এসে সাগরের নতুন প্ল্যান হলো ছুচোবাজি তৈরী করে একটু নতুন ধরনের বদলা। হরিদাদু রাত নটায় খেয়ে নিয়ে শোবার জন্য লুঙ্গি পালটে শুতে যায়। সাগর একটা ছুচোবাজি জ্বালিয়ে দাদুর সেই লুঙ্গি তাক করে ছেড়ে দেয়। সেই ছুচোবাজি সোজা গিয়ে দাদুর লুঙ্গির ভেতরে ঢুকে যায়। রাতবিরেতে সে এক ধুন্ধুমার কান্ড। সাগরের বাবা-কাকারা ছুটে গিয়ে দাদুকে ধরে ফেলে কম্বল চাপিয়ে দেয়। দাদুর যা হবার তা হয়ে গেছে। এরপর ওর বাবা সাগরের ওপর ভীষণ রেগে গিয়ে ঐ দিন রাতেই ঘর থেকে বের করে দেয়। সাগর সারারাত ঘরের বাইরে কাটায়। এমনকি কোন বন্ধুর বাড়িতেও যেতে চায়নি। পরের দিন সাগরের বাবা বললেন, ‘ও আমাদের বাড়ির কুলাঙ্গার, ওর শিক্ষা হবে না। ওকে হোস্টেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। ওকে রহড়া রামকৃষ্ণে ভর্তি করে দেয়। সেই যে সাগর গ্রামছাড়া হল, এতদিন পর ও ফিরে এলো।
প্রায় দশ মিনিটের মতো এরপর নিস্তব্ধতা। উমাপতি ও শিবেশের কাছে রমা সাগরের এই কীর্তিকলাপ শুনে যারপরনাই হতভম্ব। সাগরই সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলল - এরপরের ঘটনাগুলো এবার আমাকে বলতে দে। এতক্ষণ ধরে তোরা সব বললি......
সাগরের বাবা ওকে রহড়ায় রেখে চলে আসেন। পুরো স্কুল লাইফটা সাগর ওখানেই কাটিয়ে দেয়। ওখানে ভালো রেজাল্ট করে ওর ডাক্তারী নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সেইসময় ওর বাবা-কাকাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। সেইসময় হরিদাদু প্রায়ই সাগরের বাবার কাছে ওর খোঁজখবর নিতেন। একদিন ওর বাবার সাথে ওর কাছে এসেওছিলেন, ওকে গ্রামে নিয়ে যাবার জন্য বলেওছিলেন। কিন্তু সাগর আর ফিরে যায়নি। সেদিন রাতের ঘটনার পর ওর বাবার কুলাঙ্গারশব্দটা ওকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। ঠিকই করেছিল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েই গ্রামে ফিরবে। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করার পর ও একটা স্কলারশিপ পেয়েছিল, যেটা হল রাশিয়ার একটা নামকরা কলেজে ডাক্তারী পড়ার সুযোগ। ওখানে যাবার খরচা ও প্রাথমিক অ্যাডমিশনের জন্য বিরাট অঙ্কের টাকার প্রয়োজন ছিল। বাকি ওখানে পাঁচ বছর পড়াশোনা এবং থাকার খরচা ওদের। এইরকম সুযোগ বারবার আসেনা। ওর বাবা অনেক চেষ্টা করেও তা যোগাড় করতে পারেনি। এরপর হরিদাদু এগিয়ে আসে, ওর বাবাকে বলে নাতির ভালোর জন্য ওনার বসতবাড়িটা বিক্রি করতে চায়। ওর বাবা রাজি হয়নি। কিন্তু হরিদাদু নাছোড়বান্দা। শেষমেষ হরিদাদুর সৌজন্যে সাগর রাশিয়ায় যায়।
সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় সাগরের কাছে এতো কিছু শোনার পরে। এরপর সাগর বলে - এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না। তাই এসে আমি তোদের কাছে হরিদাদুর কথা বারবার শুনতে চেয়েছি । রাশিয়ায় যাবার পর আমার জগত অন্যরকম হয়ে যায়। সেভাবে কারোর খোঁজ খবর নিতে পারিনি। বাবার সাথে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতাম। তোরাও আমাকে ক্ষমা করিস। আমি তোদের কারোর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। ডাক্তারী পাশ করার পর আমি ওখানে একবছর এক হাসপাতালে প্র্যাক্টিস করি। তারপর আমি ফিরে আসি কলকাতায়। বাবাও আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আর গ্রামেও আসা হয়ে ওঠেনি।
শিবেশ বলল,
- তুই আমাদের খবর না রাখলে কি হবে। আমরা রাখি। আমাদের বন্ধু ডাঃ সাগর চট্টোপাধ্যায় কলকাতার একজন প্রথম সারির হার্ট সার্জেন, সেটা কি জানি না ভেবেছিস। তুই যে এখানে এসেছিস শেষপর্যন্ত সেটাই আমাদের কাছে অনেক। তুই আমাদের গ্রামের গর্ব রে।
- এবারে কালীপুজো আমরা সবাই ধুমধাম করে পালন করবো। আমাদের বাড়ি, হরিদাদুর বাড়ি আলোয় ঝলমল করবে এটাই আমার ইচ্ছা। এরজন্য যত খরচ হবে আমি দেবো। তোরা থাকিস আমার সাথে। আজ যা কিছু আমি সব এই হরিদাদুর জন্য। আর একটা কথা বলি, হরিদাদুর বাড়িটা আমারই এখন কেনা। এখন যারা আছে তারা এই বাড়িটার দেখাশোনা করে। আমার একবন্ধু সব ব্যবস্থা করেছে। আজ এই বাড়িটা আমি রমাকে উপহার দিতে চাই।
ওর এই কথা শুনে সবাই হতবাক। রমা, শিবেশ এবং উমাপতি ভাবতে পারছে না। সবাই ওকে জিজ্ঞেস করল, “ব্যাপার কি?”
- আজ থাক, অনেক বেলা হয়েছে। কাল কালীপুজোর দিনে হরিদাদুর বাড়িতেই না হয় চমক দেবো সকলকে। একটু ধৈর্য ধর সকলে।
সকলে চমকের প্রতিক্ষা করে যে যার কাজে লেগে পড়লো। ইলেক্ট্রিসিয়ানকে খবর দেওয়া হল। হরিদাদুর বাড়ি সমেত সারাবাড়ি আলোয় রাঙিয়ে তোলা হল। বাড়ির ঐ বৈঠকখানায় কালী ঠাকুরও আনা হল। বেশ জমজমাটি আয়োজন করা হলো। সাগর ওর কাকাকে বলে দিয়েছিল, যতটা সম্ভব হয় পাড়ার লোকজনকে নেমন্তন্ন করে আসতে। কালীপুজোর দিন সকাল থেকেই বাড়িতে রমরমে ব্যাপার, অনেক লোকের সমাগম। সকলে মিলিতভাবে পুজোর প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। সাগর ওর ড্রাইভারকে দিয়ে শহর থেকে অনেক বাজি আনিয়ে নিয়েছিল। সন্ধ্যের সময় ওদের বাড়ির আকাশ আলোকসজ্জায় ঝলমল করে উঠল। তারই মধ্যে রমা, উমাপতি আর শিবেশের মাথায় সেই চমকের ব্যাপারটা ঘোরাফেরা করছে। রমা বলেই ফেললো সাগরকে, “কিগো আমার তো তর সইছে না, কখন বলবে?”
- গিন্নী, একটু সবুর তো কর। রাত ৮টা নাগাদ আমরা হরিদাদুর বাড়ি যাবো। সেখানেই না হয় বলব।
- দূর ভাল্লাগে না।
সাগর মুচকি হেসে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সন্ধ্যে ৬টার মধ্যেই পুজোর সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। রাত ১১টায় পুজোর সময়, সন্ধ্যে ৭টার সময় সাগর তার কাকা নারায়নবাবু, শিবেশ, উমাপতি এবং রমাকে নিয়ে হরিদাদুর বাড়ি গেলো। সেই বাড়িতে এক স্বামী-স্ত্রী থাকতো। মুলত তারাই বাড়িটার দেখাশোনা করতো। তারা সেভাবে পাড়ার কারোর সাথে মিশতো না। শুধুমাত্র সাগরের কাকার সাথে যোগাযোগ ছিল। ওদের সাথে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলো। এরপর সাগর বলতে শুরু করলো-
- কাকা, তুমি বলবে নাকি আমি বলব। বাবা মারা যাবার পর কাকাই আমার সমস্ত কিছু দায়িত্ব নিয়েছে।
- কি যে বলিস খোকা। আমার নিজের ছেলে বা মেয়ে নেই। তোর কাকিমাও কবে ছেড়ে চলে গেছে আমাকে। তুই তো আমারই ছেলে নাকি। তোর বাবা মারা যাবার পর আমাকেই সব দায়িত্ব দিয়ে গেছে। সেই দায়িত্বতো পালন করতে হবে নাকি
- ঠিক আছে কাকা। এই বলে সাগর বলতে শুরু করল ......
হরিদাদুর দুই মেয়ে ছিল, যারা আজ এই দুনিয়ায় নেই। হরিদাদু তার বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু বিয়ের এক বছর পরেই সেই মেয়ে মারা যায়। দাদু তার ছোটমেয়ে শিখাকে বেশি ভালোবাসত। শিখা পড়াশোনা করেছিল। স্কুলের বারো ক্লাসে পড়ার সময় একটি ছেলের সাথে প্রেম হয়। দাদুকে না জানিয়েই তারা বিয়ে করে পালিয়ে যায়। দাদু ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল। প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। সেইসময় সাগরের বাবা দাদুর দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলো। সাগরের বাবা-কাকাকে দাদু নিজের ছেলের মতো করে ভালোবাসতেন। এই ভালোবাসার জন্যই দাদু সাগরকে রাশিয়ায় ডাক্তারী পড়ানোর জন্য বাড়ি বিক্রি করার কথা দুবার ভাবেননি। দাদুর ছোট মেয়ে শিখা ফিরে আসেনি। সেক্ষেত্রে দাদুর সম্পত্তির উত্তরাধিকার বলতে কেউই ছিলো না। তখন দাদুর এই বাড়ি কিনে নিয়েছিলো সাগরের এক প্রিয় বন্ধু সৈকতের বড়লোক বাবা। সাগরই তাকে বলেছিল, “কাকু আপনি বাড়িটা এই মুহুর্তে কিনে নিন, আমি ফিরে এসেই বাড়িটা কিনে নেবোএবং তারপর সাগর ফিরে এসে বাড়িটা আগে কিনে নেয়। সাগরের বাবা মারা যান ওর রাশিয়ায় থাকাকালীন, শেষ বেলায় বাবার কাছে সে থাকতে পারেনি, সেই দুঃখ চিরকালীন থেকেই যাবে। সাগর কাকাকে চিঠি লিখে সবকিছু ব্যবস্থা করতে বলেছিল। সেই অনুযায়ী ওর কাকাই বাড়িতে এই দুজনকে রাখার ব্যবস্থা করে।
সাগরের কাকা নারায়নবাবু বলেন,
- হ্যাঁ বৌমা, এরা আমার চেনাজানা। এই বাড়িতে এদের দেখাশনার জন্যই রাখা হয়েছে। হরিকাকার এই বাড়িটা সাগরের বাড়ি। আমি আগলে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মাত্র।
- কাকাবাবু, আপনিতো আমাদের অভিভাবক। এইভাবে বলবেন না। আপনি যা ভালো বুঝেছেন তাই করেছেন।
সাগর আবার বলতে শুরু করল...
হরিদাদু বাড়ি বিক্রি করার কথা যখন বলেছিলেন, তখন ওর বাবা দাদুর মেয়ে শিখাকে অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওর বাবা মারা যাওয়ার পর সেই দায়িত্ব কাকা নেয়। কাকা দাদুর ছোট মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিলেন, কিন্তু সে আর এই পৃথিবীতে ছিলো না। শিখার বর একজন মদ্যপ ছিলো। ঠিক ভাবে দেখাশোনা করেনি। একদিন শিখাকে খুন করে তারপর জেলে চলে যায়। তাদের একমাত্র মেয়ে চলে যায় কোন এক অনাথ আশ্রমে। আশ্রমেই সেই মেয়েটি ছোট থেকে বড় হয়। অনাথ আশ্রমের গুরুমার তত্ত্বাবধানে সেই মেয়ে ভালো পড়াশোনা করে এবং পরবর্তী কালে একটি স্কুলের দিদিমনি হয়। সাগরের কাকা সব খোঁজ খবর নিয়ে সাগরকে জানিয়েছিলেন। এরপর সাগর ফিরে আসে কলকাতায়। কাকার কাছে খোঁজ-খবর নিয়ে সেই মেয়েটির কাছে যায় এবং তাকে তার গৃহিনী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কাকাই সবকিছু দেখাশোনা করে বিয়ে দেন। এরপর সাগর রমাকে বলে - হ্যাঁ রমা তুমিই হলে হরিদাদুর একমাত্র নাতনী। আজ তোমাকে তোমার দাদুর বাড়ি ফিরিয়ে দিলাম।
রমার চোখ দিয়ে অশ্রুরাশি ঝড়ে পড়ছে। সে বিহ্বল হয়ে পড়লো। কি বলবে সে ভেবে পাচ্ছে না। সে সাগরকে
- তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। এতকিছু তুমি আমাকে বলোনি কেন? আমি আমার দাদুকে দেখতেও পেলাম না।

নারায়ণবাবু বলেন,
- কাঁদেনা বৌমা, তোমাকে বলার সুযোগ ছিলো নাতো। কি করে বলবো বল। আজকের এই খুশির দিনে চোখের জল ফেলতে নেই মা।
শিবেশ ও উমাপতি প্রায় একসাথে বললো,
- বৌদি, ভেবে দেখুন, আপনাকে বলে দিলে এই চমকটা হতো কি, যা হয়েছে দারুন একটা ব্যাপার হয়েছে। সাগর যে ফিরে এসে আমাদের সব্বাই কে এইভাবে চমক দেবে ভাবতে পারিনি। ও শুধু বড় ডাক্তারই নয়, খুব বড় মনের মানুষ। বৌদি, আপনি রাগ করবেন না, আজকের এই খুশির দিনে আমরা সব্বাই একসাথে আনন্দ করবো।
সাগর বলল,
- নিশ্চয়ই আনন্দ করবো। তার আগে আমি রমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। প্লিজ রমা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। একটা অনুরোধ করব তোমাকে, যদি এই বাড়িটার পাশে পুরো বাগানটায় হরিদাদুর নামে একটা হাসপাতাল করি, খুব কি খারাপ হবে। তুমি এখন মালিক, তোমার অনুমতি ছাড়া তো এগোনো যেতে পারে না। এখানকার গ্রামের মানুষের অনেক উপকার হবে, কেউ চিকিৎসার জন্য আর শহরে যাবে না।
- এইরকম বললে আমি আর কথা বলবোই না। আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি, আমি মালিকত্ব চাই না। আমার খুব ভালো লাগছে আমি অজান্তেই শিকড়ের টানে নিজের জায়গায় চলে এসেছি। এখানকার ভালো কিছু হলে আমারও খুব ভালো লাগবে। আর শোনো ডাক্তারবাবু, শুধু হাসপাতাল করাই নয়, প্রতি সপ্তাহের একটা দিন তুমি এই গ্রামের মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবে, কথা দাও। তোমার সাথে আমিও আসব।
- সে আর বলতে
সবাই সাগর আর রমার কথায় হো হো করে হেসে ফেললো। এরপর তারা ফিরে গেলো নিজেদের বাড়িতে, এবং কালীপুজোর তোরজোড় আরম্ভ করে দিলো। রাত ১১টায় যাথারীতি ব্রাহ্মণ মশাই এসে পুজো আরম্ভ করলেন। সাগর আর রমা দুজনেই অঙ্গীকারবদ্ধ হল আগামী দিনগুলোয় হরিদাদুর স্মৃতিগুলো তাদের কাজের মাধ্যমে যেন আরো বিকশিত হয়ে ওঠে।

প্রকাশিত (মুদ্রিত)
- আমাদের লেখা পত্রিকা, ২০১৯

ছবিঃ রেওয়া পত্রিকার, বিপন্ন শৈশব সংখ্যার প্রচ্ছদ থেকে আংশিক নেওয়া