"পেয়েছি তোমায় খুঁজে"
লিখেছেন - রাজকুমার ঘোষ
আমাদের পদক্ষেপ প্রকাশনী
আলোচক - সুদীপ্ত পারিয়াল
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বাকসাড়া তরুণ সংঘ লাইব্রেরির শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় অগ্রজ কবি ও গল্পকার রাজকুমার ঘোষের গল্পগ্রন্থ "পেয়েছি তোমায় খুঁজে" মুক্তির পথে এগিয়েছিল। দাদার থেকে বইটি উপহার পাওয়ার পর এক নিঃশ্বাসেই পুরো বইটি শেষ করেছিলাম। কিন্তু দাদার অনুরোধ ছিল রিভিউ লিখে দেওয়ার। একটু আশ্চর্যই লেগেছিল। এত বড় একজন কবি, সংগঠক, গল্পকার, সম্পাদক এবং সর্বোপরি একজন আদর্শ শিক্ষক আমার কাছ থেকে রিভিউ চাইছেন! আসলে রাজকুমারদা এমনই। দাদার মতন সহজ সরল মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। রিভিউ লিখছি ঠিকই, তবে এটা সম্পূর্ণই একজন সাধারণ পাঠকের মতামত।
৮০ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সব রকম প্রেমের অপূর্ব কোলাজ এঁকেছেন গল্পকার রাজকুমার ঘোষ। টক ঝাল মিষ্টি এই অনুভবের প্রকাশ তার সবকটি রচনাতেই খুঁজে পেয়েছি। বইটিতে তার পাঁচটি ছোটগল্প বা গল্প। একটি উপন্যাস রয়েছে।
সেই মেয়েটা
গল্পটি মনে করিয়ে দেয় পাঠকের কিশোর জীবনের কথা। কিশোর অবস্থায় প্রেমের চঞ্চলতা ও আবেগপ্রবণতা গল্পটির অজয় চরিত্রটিতে ফুটে উঠেছে। তবে দ্বন্দ্বের বুনট গল্পটিকে আরেকটু উন্নত করতে পারত বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
খোলা চুলে আখ্যান
ব্যক্তিগতভাবে এই গল্পটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। কিশোর প্রেমের চাঞ্চল্য তথা এক সুমিষ্ট সম্পর্কের মিশ্রণ গল্পটি এক অন্য মাত্রায় উন্নত করেছে। এ গল্পের রেশ দীর্ঘক্ষণ মনে থেকে যায়। এমন গল্প অবচেতন মনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে।
সাইকেল ও অর্গানিক কেমিস্ট্রি
এই গল্পটি অত্যন্ত মজার। সেই সঙ্গে মনোবিজ্ঞানের একটি ক্ষীণ প্রকাশ। মধ্যবিত্ত জীবনের দারিদ্রতা, ও বুঝিয়ে মেনে চলা, মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেরাই বোঝে। সেই সঙ্গে পূর্বপুরুষের স্মৃতি বহন। প্রেমিকার আদর অভ্যর্থনা, সব মিলিয়ে এই গল্পটি একটি সার্থক ছোটগল্প।
স্বপ্ননীল
রেখা চরিত্রটি বোধহয় আমাদের অন্তরের একটি চরিত্র। আমার মনে হয়েছে আমাদের সকলের সুপ্ত বাসনার মতন এমন একটি চরিত্র অন্তরে লুকিয়ে থাকে। যাদের ইচ্ছে করে অসুন্দরের প্রতি আসক্ত হতে। এই অসুন্দর বাহ্যিক আর সুন্দর নয়, অন্তর্নিহিত অসুন্দর। সেই আসক্তি অসুন্দরকে সুন্দরতর করে তোলার চেষ্টায় রত থাকে সারাক্ষণ। এই আত্মনিবেদন আজকের দিনে খুব একটা দেখা যায় না। সমাজ যখন অবনমনের পথে তখন এই ধরনের একটি গল্প নিছক প্রেমের গল্প নয়, সামাজিক ও শিক্ষণীয় গল্পও বটে। গল্পটি বারবার পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়। তবে সিনেম্যাটিক কায়দায় সমাপ্তি না টেনে, গল্পকার এ গল্পের শেষ অংশটা পাঠকদের ভাবার জন্য ছেড়ে দিতে পারতেন।
স্বীকৃতি
এই গল্পটি মানবিক সম্পর্কের পাশাপাশি, সমাজের কিছু শ্রেণীর মানুষের বক্রদৃষ্টির প্রকাশ। তার বিরুদ্ধে গর্জন করেছে মানবিক সম্পর্ক। শুক্লা ও মহাদেবের প্রেম থাকুক বা নাই থাকুক। ওদের যে মানবিক বন্ধন তাই যেন ওদের প্রেমের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। তার থেকেও বড় কথা মানবিক সম্পর্কে প্রতি সকলের দায়বদ্ধতার কথা লেখক যেন এই গল্পটির মাধ্যমে সকলকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন।
উপন্যাস-পেয়েছি তোমায় খুঁজে
একটি মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস "পেয়েছি তোমায় খুঁজে"। কিশোর যুবক তথা সকল বয়সের মানুষের জন্যই সহজ সরল ভাষায় লেখা একটি পরিচ্ছন্ন উপন্যাস। জটিলতা বা দ্বন্দ্ব বা কোন কঠিন শব্দ চয়নও খুব একটা চোখে পড়ে না। এক কথায় বলতে গেলে উপন্যাসটি মনের মধ্যে গেঁথে যায়। তবে রিভিউ করতে বসে, শুধু ভালো দিকগুলোই বলবো! যেগুলো একটু ত্রুটি মনে হল সেগুলোও একটু বলার চেষ্টা করছি। অজান্তে লেখকের মনে আঘাত দিলে আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে রাখছি।
প্রথমেই বলি আমি জানি না উপন্যাসটি লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা কিনা! সাধারণ পাঠক হিসেবে এটা জানবার কোন প্রয়োজন বোধ হয় না। শুধুমাত্র গল্প পড়ার আনন্দে উপন্যাসটি পড়েছি। তবে উপন্যাসের প্রথম শর্ত সংলাপ ও লেখকের বক্তব্যের ভিন্নধর্মিতা। সেই জায়গাতে কোথাও যেন এক হয়ে গেছে এই উপন্যাসটি। এটি যেমন এক ক্ষেত্রে ভালো দিক। আবার কখনও কোন ঋদ্ধ পাঠক যখন পড়বেন তখন তার মনে হতেই পারে যে চরিত্রের বলা সংলাপ অর্থাৎ কথিত সংলাপ ইংরেজিতে যাকে বলে কলোকয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ, তার প্রয়োগ সব জায়গায় সমান চোখে পড়ল না। একটি উদাহরণ দিই,
রেখাপাত, প্রতিকূল ইত্যাদি শব্দ বহুবার ব্যবহার করা হয়েছে সংলাপ নির্মাণের ক্ষেত্রে। আরও একটি কথা, রাজেনের বয়স আন্দাজে তার সংলাপ অনেক শিশুসুলভ। একইভাবে প্রায় প্রতিটি চরিত্রেরই সংলাপ নির্মাণ খুব একটা আলাদা করা যায় না। বয়সের ভিন্নতা অনুযায়ী সংলাপের ধরন পাল্টালে উপন্যাসটি আরও একটু সমৃদ্ধ হতো।
দ্বিতীয়তঃ লেখকের বক্তব্য, লেখকের ব্যাখ্যায়
'ফাটাফাটি', 'ভীষণ ভালো' , প্রভৃতি শব্দ একটু কানে লাগে। এর বিকল্প ভাবা যেতে পারে। আর 'ভীষণ ভালো' শব্দটির ক্ষেত্রে, ব্যাকরণগত ভুল আছে। ভুলের কথা অধিকাংশ বাংলা সাহিত্যিকরাই জানেন না। ভীষণ শব্দটি নেতিবাচক। সুতরাং কোনও নেতিবাচক ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা এই শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। যেমন ভীষণ ঝড় উঠেছে,আমার ভীষণ বিপদ ইত্যাদি। কিন্তু কোন ইতিবাচক কথা বা ঘটনার ক্ষেত্রে ভীষণ শব্দটি প্রয়োগ করলে সেটি ব্যাকরণগতভাবে ভুল হয়। এই নিয়মটি অধিকাংশ লেখকরাই মান্য করেন না। এক্ষেত্রে একটু নজর দিলে মনে হয় ভালো হয়। 'আগামীদিন' শব্দটিও ব্যাকরণগতভাবে শুদ্ধ নয়। 'আগামী দিন' শুদ্ধ। যদি আগামীদিন লিখি তাহলে 'মী' না লিখে 'মি' লিখতে হবে। অর্থাৎ আগামিদিন। মত শব্দের পরিবর্তে মতো বা মতন লিখলে নির্ভুল হবে।
এবার উপন্যাসের বর্ণিত কিছু ঘটনা সমূহের ব্যক্তিগত মন্দলাগা বা ভালোলাগা নিয়ে বলতে চাই।
পাত্রী দেখা
যদি ঘটনাটি আজ থেকে কুড়ি- ত্রিশ বছর আগেরকার হয়, তাহলে গায়ত্রী ক্ষেত্রে পাত্রী দেখার নিয়মটি ঠিক আছে। কিন্তু আধুনিক সমাজে লেখকের দায়িত্ব অনুযায়ী পাত্রী দেখার বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখককে একটু ভাবতে অনুরোধ জানাই। তবে উপন্যাসে গায়িত্রী চরিত্রটি যেভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে আমার মনে হয়েছে, নায়িকা সুলভ সমস্ত গুণই তার মধ্যে বর্তমান। কিন্তু তার বাহ্যিক কোন বর্ণনা দেওয়া হয়নি। আর হলেও আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে হয়তো। শুধুমাত্র গায়ের রং কালো বলে রাজনের মা, যে নিজেও একজন নারী সে একটি মেয়েকে নিজের সুপুরুষ সন্তানের জন্য বাতিল করে দিল এটা একটু ভাবায়! তাহলে মায়ের চরিত্রটিরও নির্মাণ প্রসঙ্গে আরও একটু দ্বন্দ্ব প্রয়োজন।
রুপালি চরিত্রটি নির্মাণ
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই দুটি দিক থাকে। মুখ ও মুখোশ। রুপালি যেন শুধু মুখই। তার কোন মুখোশ নেই। সে যখন প্রকাশ্যেই রাজেনকে জানাচ্ছে সে অনেক পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করে, তখন রাজেনের কি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়, অনেক পুরুষের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক থাকতে পারে! চরিত্রটির কোনও ইতিবাচক দিক দেখানো হয়নি।
তুলি চরিত্রটি নির্মাণ
রাজেনের জীবনে যে কটি নারী চরিত্র এসেছে, তার মধ্যে তুলি চরিত্রটি সবথেকে সুন্দর বলে আমার মনে হয়। আসলে উপন্যাসটি পুরোপুরি রাজেনকেন্দ্রিক। তাই অন্যান্য চরিত্রগুলির মানবিক বিশ্লেষণ করা হয়নি। তুলির মানবিক বিশ্লেষণ করা হলে বোঝা যায়, তার কথাগুলি খুবই বাস্তবসম্মত। হয়তো তার মধ্যে শারীরিক চাহিদার স্পৃহা জাগিয়ে, তাকে নেতিবাচক করা হয়েছে। তবে রাজনের প্রথম প্রেম তুলি আমার কাছে তার কাছে শ্রেষ্ঠ প্রেম।
হয়তো অনেক বেশি বলে ফেললাম। তবে পাঠক হিসেবে একদম সততার সঙ্গে সবকিছুই বললাম। অভিনন্দন জানাই লেখক রাজকুমার ঘোষকে।